নদীমাতৃক বাংলার নদী ফিরুক চিরচেনা রূপে

User

শিক্ষার্থী , রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

লেখক


রেজী:
BCW24120008

প্রকাশিত:
২৫ এপ্রিল ২০২৫

আপডেট:
২৫ এপ্রিল ২০২৫

নদীমাতৃক বাংলার নদী ফিরুক চিরচেনা রূপে।

 

 

বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। এদেশে জালের মত ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে নাম না জানা অসংখ্য নদ- নদী। 

বাংলাদেশে নদ নদীর প্রকৃত সংখ্যা নিয়ে যথেষ্ট বির্তক রয়েছে। প্রচলিত তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে নদ নদীর সংখ্যা ৭০০টি। কিন্তু পানি উন্নয়ন বোর্ডের মতে বাংলাদেশে মোট নদ নদীর সংখ্যা ৪০৫ টি। ২০২৩ সালে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন ছোট-বড় ১০০৮ টি নদ নদীর তালিকা তৈরি করে। সংখ্যা নিয়ে বির্তক থাকলে পৃথিবীতে এত নদীবিধৌত দেশ দ্বিতীয় আরেকটি নেই। কবি অতুল প্রসাদ সেন এর মতে এদেশ তেরশত নদীর দেশ। মূলত নদীমাতৃক বাংলার নদ- নদী'র আধিক্যতা বোঝাতেই শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। 

কিন্তু নদীমাতৃক বাংলার পূর্বের সেই রূপ আর নেই। নানাবিধ কারণে নদীগুলো আজ বিলিন হয়ে যাচ্ছে।

একসময় ছিল যখন নদী ছিল বাংলার অর্থনীতির প্রাণকেন্দ্র। নদীকে কেন্দ্র করে যাবতীয় অর্থনৈতিক কার্যবলি পরিচালিত হত। পৃথিবীর যত বড় বড় সভ্যতার সৃষ্টি হয়েছে, সবগুলোই নদীকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। মূলত নদী পথে যোগাযোগের সহজলভ্যতাকে কাজে লাগিয়ে নদীর তীরে সভ্যতা, হাট বাজার, নগর গড়ে উঠতো। প্রাচীন বাংলার অধিকাংশ জনপদই ছিল নদী কেন্দ্রীক। জনপদগুলোর  রাজধানীও ছিল নদীর তীরে। প্রাচীন পুন্ড্র, গৌড়, চন্দ্রদীপ, বঙ্গ ইত্যাদি সমৃদ্ধ জনপদগুলো নদীর তীরে গড়ে উঠেছিল। প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতা নীল নদকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল। নীল নদের অববাহিকায় ফসল চাষাবাদ করা হত। যা ছিল তাদের অর্থনীতির অন্যতম চালিকা শক্তি। এজন্য ঐতিহাসিক হেরোডোটাস মিশরকে নীল নদের দান বলে অভিহিত করেছেন।

প্রত্যক বছর বন্যায় নদীর অববাহিকায় বিপুল পরিমাণ পলিমাটি বয়ে নিয়ে আসে। যা জমির উর্বরা শক্তিকে বৃদ্ধি করে। বাংলাদেশের অধিকাংশ ভূমি নদীর পলিমাটি অববাহিকা দ্বারা গঠিত। এদেশের বুক চিরে ২৪১০০ কিলোমিটার জায়গা জুড়ে অসংখ্য নদ নদী প্রবাহিত হয়েছে। নদীর পানির সহজলভ্য সেচ ব্যবস্থাকে কাজে লাগিয়ে ফসল আবাদ হয়। যা ভূগর্ভস্থ পানির চাপ কমায়। 

বাংলাদেশে প্রায় ৫ কোটি মানুষ নদীপথে যাতায়ত করে। যা মোট যাত্রী পরিবহনের এক চতুর্থাংশ। দক্ষিনাঞ্চলের যাতায়তের অন্যতম মাধ্যম নদীপথ। 

নদীতে প্রচুর পরিমাণ মাছ পাওয়া যায়। যা জেলে সম্প্রদায়ের জীবিকার প্রধান উপজীব্য। মাছে ভাতে বাঙালির মাছ আমিষের প্রধান উৎস। যার অনেককাংশে নদীগুলো থেকে আসে। জিডিপির ৩.৬৭ শতাংশ আসে মংস্য খাত থেকে। শতকরা ৬০ শতাংশ মানুষ খাদ্যের জন্য নদীর উপর নির্ভরশীল।

মানুষের কল্যাণে নদী তার সর্বত্র বিলিয়ে দিলেও কেউ তার এই উপকার স্বীকার করতে রাজি নই। প্রতিনিয়তই বিভিন্ন অজুহাতে নদীশাসন চলছে। 

নদীর দুই তীরে চলছে কল কারখানা নির্মাণের মহা উৎসব। এসব কল-কারখানা হতে নির্গত বজ্য পদার্থ সরাসরি নদীর পানিতে পতিত হয়। যা নদীর পানিকে দূষিত করে। নদীকে কেন্দ্র করে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন গঞ্জ - নগর গড়ে উঠছে। যার অধিকাংশ পরিকল্পনা বিহীন।

অপরিকল্পিত শিল্পায়ন ও নগরায়নের ফলে নদীগুলো আজ হুমকির সম্মুখীন। 

এছাড়া নদীতে বড় বড় জাহাজ, লঞ্চ, স্টিমার চলাচল করে। এসব জাহাজ, লঞ্চ থেকে নির্গত তেল জাতীয় পদার্থ ও বজ্য নদী দূষণের অন্যতম কারণ। 

শহরের আর্বজনা - বজ্য পদার্থগুলো অধিকাংশ সময় নদীর তীরে অপসারণ করা হয়। অবশিষ্ট উৎছিষ্ট আর্বজনা বৃষ্টির পানিতে ধুয়ে ড্রেন, নালা, নর্দমা, খাল বিলের মাধ্যমে নদীতে পতিত হয়। ফলে নদীগুলো তার নিজস্ব স্বকীয়তা হারাচ্ছে। 

তাছাড়া নদী ভরাট করে জায়গা দখল করার প্রতিযোগিতা তো আছেই। প্রভাবশালী মহল নদীর দুই তীর ভরাট করে ভবন, মার্কেট, শপিং মল গড়ে তুলছে। ফলে নদীগুলো ক্রমশ সরু হয়ে আসছে। একসময় পানি প্রবাহের পথ বন্ধ হয়ে নদীগুলো মারা যায়। নদীর বুক থেকে অবৈধভাবে বালি উত্তোলনের ফলে দুই তীরে ভাঙ্গন দেখা দিচ্ছে। প্রতিবছর হাজার হাজার কৃষি জমি নদীগর্ভে বিলিন হয়ে যাচ্ছে। নদী ভাঙ্গনের কবলে সর্বশান্ত হয়ে লাখ লাখ মানুষ গৃহহীন জীবন - যাপন করছে। 

তাছাড়া ভারতের সাথে আমাদের ৫৪ টি আন্তঃসংযোগ নদী রয়েছে। ভারত সরকার কর্তৃক নদীর বিভিন্ন স্থানে বাঁধ নির্মাণের ফলে নদীর নাব্যতা হ্রাস পাচ্ছে। 

দীর্ঘদিন নদীগুলো ডেজিং না করায়, নদীর বুকে চর জেগে উঠে। যা পানি প্রবাহে বাধা সৃষ্টি করে।

একসময় মরা নদীতে পরিণত হয়।

এভাবে প্রতিনিয়ত বিভিন্ন অজুহাতে নদীশাসন চলছে। ইতিমধ্যে অনেক ছোট নদী মৃত নদীতে পরিণত হয়ে গেছে।

ক্রমশ নদী ভরাট, চর সৃষ্টির ফলে পানি প্রবাহ হ্রাস পেয়ে অনেক নদী সরো খালে পরিণত হয়ে গেছে।

বড় নদীগুলোর অবস্থাও মৃতপ্রায়। মাত্রারিক্ত দূষণের কারণে বুড়িগঙ্গা নদী মৃত নদীতে পরিণত হয়েছে। বুড়িগঙ্গা নদীতে কোন মাছ পাওয়া যায় না। ওয়ার্ল্ড ফিশ নামক একটি আন্তর্জাতিক সংস্থার সমীক্ষা অনুযায়ী, রাজধানীর চারপাশের নদীগুলোর দূষণের মাত্রা এতটাই বেশি যে, সে নদীর মাছের বেঁচে থাকা প্রায় অসম্ভব।

শুষ্ক মৌসুমে যমুনা নদীতে গরুর গাড়ি চলাচল করতে দেখা যায়। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের সমীক্ষা অনুযায়ী, প্রায় ১৭৫টি নদীর অবস্থা বিপন্ন এবং প্রায় ৬৫টি নদী মুমূর্ষু অবস্থায় রয়েছে৷ এদের মধ্যে ৮০ শতাংশ নদীর গভীরতা খুব কম।  

এরূপ অবস্থা চলতে থাকলে নদীমাতৃক বাংলা তার চিরচেনা রূপ হারাবে।

এর থেকে পরিত্তাণের জন্য নদী শাসন বন্ধ করতে হবে।  

নদীগুলো দখলমুক্ত করতে হবে। নদীর তীরে অবৈধভাবে গড়ে উঠা প্রতিষ্ঠানগুলো গুড়িয়ে দিতে হবে। দখলকারী যতই শক্তিশালী হোক না কেন প্রয়োজনে তাদের বিরুদ্ধে আইনত ব্যবস্থা নিতে হবে।

নদীর দুই তীর দখলমুক্ত করে পার্ক, অবকাশকেন্দ্র বা হাঁটার উপযোগী করে তোলা যেতে পারে।

শিল্প-কারখানা যতটা সম্ভব নদীর তীর হতে দূরে স্থাপন তুলতে হবে। বর্জ্য নিষ্কাশনের বিষয় মাথায় রেখে বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫ (২০১০-এ সংশোধিত)- প্রণিত ধারা ১২-তে বলা হয়েছে, পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে ‘পরিবেশগত ছাড়পত্র’ ছাড়া কোনো শিল্পপ্রতিষ্ঠান স্থাপন করা বা প্রকল্প গ্রহণ করা যাবে না।

সর্বোচ্চ ক্ষতিসাধনকারী টেক্সটাইল, পাল্প, পেপার, চামড়া, কেমিক্যাল, ওষুধ, খাদ্য উৎপাদনকারী, সিমেন্ট, চামড়া ইত্যাদি শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো স্থাপন করার পূর্বে পরিবেশতগত ছাড়পত্র নিতে হবে। সেই অনুযায়ী বজ্য নিষ্কাশন করতে হবে। এ ব্যাপারে আইনের কড়াকড়ি আরোপ করতে হবে। 

নগর পরিকল্পনাবিদের পরিকল্পনা অনুযায়ী পরিকল্পিত নগরায়ন গড়ে তুলতে হবে। শহরের বজ্য পদার্থগুলো নদীর তীরে না ফেলে লোকালয় থেকে দূরে একটি নির্দিষ্ট স্থানে ফেলতে হবে। নদীর নাব্যতা ফিরিয়ে আনতে নিয়মিত ডেজিং করতে হবে। অবৈধ বালি উত্তোলন বন্ধ করতে হবে। যারা অবৈধভাবে বালি উত্তোলনের সাথে জড়িত তাদের বিরুদ্ধে আইনানুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে। ভাঙ্গন প্রতিরোধে নদীর দুইপাশে টেকসই বাঁধ নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। আন্তঃসংযোগ নদীগুলোর ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক নদী আইন অনুসারে নদীর পানি বণ্টন নিশ্চিত করতে হবে। বিষয়টি সরকারী পর্যায়ে সীমাবদ্ধ না রেখে ব্যক্তি পর্যায়েও এগিয়ে আসতে হবে। প্রত্যেকে নিজ নিজ জায়গা থেকে সচেতন হলেই নদীমাতৃক বাংলার চিরচেনা রূপ ফিরে পাবে।


 

মোঃ সবুজ মিয়া

রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ,

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।