"তঞ্চঙ্গ্যা সম্প্রাদায় ও তাঁদের ঐতিহ্যবাহি ঘিলা খেলা"
বাংলাদেশ বহুজাতির দেশ। বৃহত্তর বাঙালি জাতিগোষ্ঠীর পাশাপাশি এই দেশে রয়েছে প্রায় ৫০ টির বেশি ভিন্ন ভিন্ন জাতির বসবাস। সমগ্র বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে ভৌগোলিকগত অবস্থানের দিক দিয়ে সমতলের পাশাপাশি আংশিক পাহাড়-পর্বত দেখা যায় চট্টগ্রাম বিভাগে। দক্ষিণ-পূর্বাংশের রাঙ্গামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি এই তিন পার্বত্য জেলায় বসবাস করতে দেখা যায় তঞ্চঙ্গ্যা'দের।
তিন পার্বত্য জেলার মধ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা তঞ্চঙ্গ্যা সম্প্রদায়ের মধ্যে রাঙ্গুনিয়ার রইস্যাবিলি, সাদিক্যাবিলি, বাঁশবুনিয়া, হারকিলা বিলি কাউখালী উপজেলার বেতছড়ি, বগাপাড়া, মিতিঙ্গ্যাছড়ি, ঘাগড়া, কাপ্তাই উপজেলার বরইছড়ি দেবতাছড়ি, সাপছড়ি, হাতিমারা, ওয়াগ্গা, বটতলী, ঘাগড়া বাজার হতে বারঘোনিয়া, মানিকছড়ি এলাকা, রাজভিলা ও রমতিয়া বান্দরবান জেলার রোয়াংছড়ি, আলীকদম, রুমা, লামা, নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলায়ও রয়েছে তঞ্চঙ্গ্যাদের বসবাস। রাঙ্গামাটির রাজস্থলী ও বিলাইছড়ি উপজেলায় রয়েছে বিপুলসংখ্যক তঞ্চঙ্গ্যাপার্বত্য জেলা ব্যতীতও কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার তেলখোলা, মোছারখোলা, মাদারবনিয়া টেকনাফ উপজেলার উয়েখোলা, লম্বাঘোনা, হরিখোলাসহ কয়েকটি এলাকায় তঞ্চঙ্গ্যারা ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসবাস করে আসছে।
বাংলাদেশে বসবাসরত তঞ্চঙ্গ্যাদের মোট ১২টি গোষ্টী আছে, এদেরকে বলা হয় গছা। তন্মধ্যে - মো গছা, কার্বুয়া গছা, ধন্যা গছা, মংলা গছা, মলং গছা, লাং গছা., অঙ্য গছা, লাপোস্যা গছা, ওয়া গছা, তাশ্বী গছা ও মুলিমা গছা। এদের ভিতর ৭টি গছা ( মো গছা, কার্বুয়া গছা, ধন্যা গছা, মংলা গছা, মলং গছা, লাং গছা., অঙ্য গছা) বাংলাদেশে বাস করে। অবশিষ্ট ৫টি গছা একসময় বাংলাদেশে ছিল, পরে আরাকানে চলে যায়।
যাদের পোশাক-আশাক, জীবনবৈচিত্র্য, সংস্কৃতির ঐতিহ্য সবই প্রকৃতির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসকারী জাতিগোষ্ঠীর বৃহত্তম সামাজিক উৎসব এপ্রিল ১২ তারিখ থেকে শুরু হয়ে ৩/৪ দিন পর্যন্ত সেটি চলমান থাকে । চাকমা, মারমা সম্প্রদায়ের মতো তঞ্চঙ্গ্যা সম্প্রদায়রাও এই উৎসবটি খুব আনন্দের সাথে পালন করে থাকে। যেটিকে 'বিষু' নামে বলা হয়ে তঞ্চঙ্গ্যা ভাষায়। বাংলা নববর্ষের ঠিক একদিন আগে এই বিষু উৎযাপন করা হয়। এই বিষু উৎসবকে কেন্দ্র করে মূলত তঞ্চঙ্গ্যা সম্প্রদায়ের লোকজন ঘিলা খেলা খেলে থাকে। এই খেলাটি খেলার জন্য একমাত্র উপকরণ হলো ঘিলা । লোকমুখে শুনা যায় যে, ঘিলা তঞ্চঙ্গ্যা'দের একটি পবিত্র ফল। এটি সাধারণত গহীন জঙ্গলে লতায় জন্মানো এক প্রকার সীম জাতীয় লতার বীজ। যার বিজ্ঞানী নাম Entada Rheedii, Family: Fabaceae. Entada Rheedii সাধারণত আফ্রিকান ড্রিম হার্ব বা snuff box sea bean নামে এবং জ্যামাইকার Cacoon Vine হিসেবেও পরিচিত।
তঞ্চঙ্গ্যা সম্প্রদায়ের বিশ্বাস, ঘিলার লতায় ফুল থেকে বীজ (গোটা) জন্মালেও এর ফুল পবিত্র দেবংশি (স্বর্গীয়) বস্তু হওয়ায় সাধারণ মানুষ ঘিলা ফুলের দেখা পান না। যাঁরা মহামানব হয়ে জন্মগ্রহণ করেছেন একমাত্র শুধু তারাই এ ফুলের দেখা পান।ফুলের পরিবর্তে ঘিলাকে পবিত্র হিসেবে সংগ্রহ করা হয়। পাহাড়ি অঞ্চলে অনেকের ঘরে ঘরে দরজায় ঘিলা ঝুলিয়ে রাখতে দেখা যায়। তাদের একমাত্র বিশ্বাস যে, বাড়ির দরজায় ঘিলা ঝুলিয়ে রাখলে অপদেবতা থেকে মুক্ত থাকা যায়। এছাড়াও এই ঘিলাখেলা তঞ্চঙ্গ্যা জনগোষ্ঠীর শত বছরের ঐতিহ্যবাহী একটি খেলা। নারী-পুরুষ উভয়েই এই খেলায় অংশ নেন। বিশেষ করে ছোট থেকে শুরু করে যুবক-যুবতীদের বেশি সংখ্যক খেলতে দেখা যায়।
লেখক: উজ্জ্বল তঞ্চঙ্গ্যা,
শিক্ষার্থী রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।