প্রাগৈতিহাসিক অভয়ারণ্য সুন্দরবন: সমকালের দর্পণে বাঙালি সংস্কৃতির বৃত্তবলয়
১. প্রাক কথন
সুন্দরবন সম্পর্কিত আলোচনা পৃথকভাবে কেবল বাংলাদেশ বা পশ্চিমবঙ্গের সীমানার প্রেক্ষিতে অগ্রসর হলে, তা কিছুতেই পূর্ণতা পেতে পারে না। রাজনৈতিক সীমানা দ্বারা সুন্দরবনকে যতই বিভাজিত করা হোক না কেন, সুন্দরবন তার প্রাকৃতিক গঠন, মেজাজ ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে অবিচ্ছেদ্য; অখণ্ড। বঙ্গের প্রাচীনত্ব, গঙ্গা ও সুন্দরবনের র উৎপত্তির সাথে সাথে এদেশের পুরাণ কথা, ইতিহাস, কিংবদন্তি, সাহিত্য এবং শিল্পের যে ধারাবাহিক সংযোগ তা যুগে যুগে বাংলার জনজীবনের সম্পদ হয়ে উঠেছে। নদীর গঠন, প্রবাহ, চরের আকার, প্রকৃতি, জনবসতি অনুযায়ী গড়ে উঠেছে সুন্দরবন; হয়েছে লোকালয়ের নামকরণ। কখনো শাসকের ধর্মীয় পরিচয়ের সাথে সে নামকরণও নতুন করে হয়েছে। যে দেশের নদীর নাম এত সুন্দর, যে দেশের ফুল-পাখির নাম এত শ্রুতিমধুর; প্রাচীন ভারতীয় শাস্ত্রে সেদেশের মানুষকে ম্লেচ্ছ, অনার্য, চণ্ডাল, চণ্ডভণ্ডাল প্রভৃতি নামে অভিহিত করা হয়েছে। হিন্দু ব্রাহ্মণের সংস্কৃত ভাষা এবং মুসলিম ব্রাহ্মণের আরবি-ফারসি ভাষা না জানার কারণে এদেশের প্রাকৃতজনকে চিরকাল অস্পৃশ্য জ্ঞান করা হয়েছে। বৈদিক যুগ শেষ হয়েছে, রামায়ণী যুগ এসেছে, মহাভারতীয় যুগেরও শেষ হয়েছে। নতুন করে এসেছে জৈন-বৌদ্ধ যুগ; গুপ্ত সাম্রাজ্য এসেছে, নতুন করে শুরু হয়েছে মাৎস্যন্যায়। বৌদ্ধ সংঘারামের টিমটিমে আলোয় মানুষ দেখেছে মুক্তির স্বপ্ন। সে আলো নিভতে না নিভতেই এসেছে সেনদের শাসন। তারাও হারিয়ে গেছে একদিন। এসেছে পাঠানের রাজত্ব; এসেছেন রূপসনাতন, লোকনাথ ব্রহ্মচারিজী, এসেছেন বনবিবি, দক্ষিণা রায়, সোনাপীর-সোনা রায়, মাণিক পির আরও কত পির আউলিয়া, চৈতন্য, মাদার, গাজী, কালু, দক্ষিণা রায়, খানজাহান আলী; বঙ্গের মানুষ আবার জাতের মুখে কালি দিয়ে একসাথে বসতে শিখলো। পাঠানেরও দিন শেষ হলো, এলো মগ-ফিরিঙ্গি-বর্গী, এলো মোগল; ঋজু হয়ে দাঁড়ালো বারো ভুঁইয়া; গঙ্গায় অনেক জল বয়ে গেল। হারিয়ে গেল কত মসজিদ, মন্দির; মগ-ফিরিঙ্গি বর্গীর আগমনে কত লহু ঝরলো, কত নারী শিশু পড়লো ক্রীতদাসের জিঞ্জির। নবাবীরও শেষ হলো একদিন। ইংরেজ এলো, এলো কোম্পানীর আইন। ব্রিটিশ রাজের সূর্যাস্ত আইন এলো, এলো চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত। এলো নীল বাণিজ্য, এলো রেশম আর মসলিনের দুর্দিন; জামদানিও শেষ হলো একদিন। পড়ে রইলো শিল্প-স্থাপত্য, গীর্জা-মসজিদ-মাজার-মন্দির, পড়ে রইলো ইমামবাড়া, লোকসাহিত্য কথকতা, পাঁচালী, জারি-সারি, ঘাটুগান, পালাগীত, বাউল, গম্ভীরা, আলকাপ, গাজীর গীত, পটের গীত, মর্সিয়া আর আর কবি সঙ্গীত। তারপর তিলে তিলে জমলো বিদ্বেষ, রাই কুড়াতে কুড়াতে হলো সাম্প্রদায়িকতার বেল। হিন্দু-মুসলিম ভাগ হলো, একের রক্তে অন্যে ভিজলো। গঙ্গায় বইলো লহু ধারা। ভারত বিভক্ত হলো, বিভক্ত হলো বাংলা। সুন্দরবনে কাল্পনিক সীমানা উঠলো, রয়ে গেল ব্রহ্মপুত্র- কালিন্দী-গঙ্গা-হুগলীর ¯্রােত, রয়ে গেল নতুন চর জেগে ওঠার প্রবণতা।
২. সুন্দরবনের পরিচয়
বঙ্গদেশের দক্ষিণে অবস্থিত ভাটি অঞ্চলে সুন্দরবনকে বাদাবন বা বাদা ভূমি নামে অভিহিত করা হয়ে থাকে। সংস্কৃত গ্রন্থে সুন্দরবনকে বলা হয়েছে, বাদা ভূমি ও সুন্দরং বনং। অুতীতের বাকলা রাজ্যের অধীন সুন্দরবন বঙ্গদেশের নিম্নভাগে অবস্থিত। সংস্কৃত শাস্ত্রগ্রন্থে বঙ্গদেশকে পৌরাণিক দেশ হিসেবেই উল্লেখ করা হয়েছে। শাস্ত্রগ্রন্থে বঙ্গদেশের নাম এবং সীমা যেমন চিহ্নিত করা হয়েছে; তেমনই সুন্দরবনের নামও উল্লেখ করা হয়েছে স্পষ্ট ভাষায়। দিগি¦জয়প্রকাশবৃত্তি নামক সংস্কৃত গ্রন্থে উক্ত হয়েছে:
‘পূর্বে মধুমতী সীমা পশ্চিমেচ ইচ্ছামতী।
বাদা ভূমি দক্ষিণে চ কুশোদ্বীপোহিচোত্তরে’।।
একই গ্রন্থের অন্যস্থানে বলা হয়েছে:
‘মেঘনানদী পূর্ব ভাগে পশ্চিমেচ বলেশ্বরী।
ইন্দিলপুরী যক্ষ সীমা দক্ষিণে সুন্দরং বনং।।
ত্রিংশৎ যোজন বিমিতো সোম কান্তাদ্রি বর্জিতঃ।
সোম কান্তেচ দ্বৌ দেশৌ বিখ্যাতৌ নৃপশেখর।।
জম্বুদ্বীপঃ পশ্চিমেচ স্ত্রীকারোহি তথোত্তরে।
বাকলাখ্য মধ্যভাগে রাজধানী সমীপতঃ’।।
অর্থাৎ মেঘনা নদী পূর্ব সীমা, বলেশ্বর নদ পশ্চিমে, উত্তরে ইদিলপুর, দক্ষিণে সুন্দরবন; এই ভূ-ভাগ মধ্যে ত্রিশ যোজন পরিমিত পর্বতবিহীন সোমকান্ত দেশ, ইহার মধ্যে পশ্চিমে জম্বুদ্বীপ এবং উত্তরে স্ত্রীকার, মধ্যস্থলে বাকলা নামক রাজধানী। ‘বঙ্গদেশের দক্ষিণ-সীমায় অবস্থিত সমুদ্র-কূলবর্তী জঙ্গলাকীর্ণ ভূ-ভাগকে সুন্দরবন বলে। নি¤œবঙ্গে যেখানে গঙ্গা বহু-শাখা বিস্তার করিয়া, সাগরে আত্মবিসর্জন করিয়াছেন, প্রাচীন সমতটের দক্ষিণাংশে অবস্থিত সেই লবণাক্ত বল্বলময় অসংখ্য বৃক্ষগুল্ম-সমাচ্ছাদিত শ^াপদ-সঙ্কুল চরভাগ সুন্দরবন বলিয়া পরিকীর্তিত হয়। ইহা পশ্চিমে ভাগীরথীর মোহনা হইতে পূর্বে মেঘনার মোহনা পর্যন্ত বিস্তৃত। কেহ কেহ মেঘনার মোহনারও পূর্বে অর্থাৎ নোয়াখালি, চট্টগ্রাম প্রভৃতি জেলার এবং হাতিয়া, সন্দ্বীপ প্রভৃতি দ্বীপের দক্ষিণভাগে অবস্থিত বনভাগকেও সুন্দরবনের অন্তর্গত মনে করেন। প্রকৃতপক্ষে গঙ্গা ও মেঘনার অন্তর্বর্তী ভূ-ভাগই সুন্দরবন। ইহা বর্তমানে চব্বিশ পরগনা, খুলনা এবং বাকেরগঞ্জ এই তিনটি জেলার অন্তর্গত এবং এই তিনটি জেলার যে অংশ চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের স্বত্বাধীন, তাহার দক্ষিণভাগে অবস্থিত। পূর্ব-পশ্চিমে সুন্দরবনের দৈর্ঘ ১৬০ মাইল এবং উত্তর-দক্ষিণে ইহার প্রস্থ পশ্চিম দিকে ৭০ মাইল হইতে পূর্বদিকে ৩০ মাইলের অধিক হইবে না। গড়ে বিস্তৃতি ৫০ মাইল ধরিলে সুন্দরবনের পরিমাণফল ৮০০০ বর্গমাইল হয়। তন্মধ্যে খুলনা জেলার মধ্যে ২২৯৭ বর্গমাইল রক্ষিত বন বা কাঁচা বাদা, উহাতে লোকের বসতি নাই। তবুও নদীপথে নৌকায় সর্বদা ৪/৫ হাজার লোক থাকে। এই বসতিশূন্য রক্ষিত বন খুলনার অন্তর্গত দাকোপ, কালীগঞ্জ, শ্যামনগর, রামপাল, মরেলগঞ্জ ও শরণখোলা, এই কয়েকটি থানার শাসনাধীন। তাহারও প্রায় ৫০০ বর্গমাইল জলভাগ। পশ্চিমে ভাগীরথী হইতে কালিন্দী নদী পর্যন্ত চব্বিশ-পরগণা, কালিন্দী হইতে মধুমতী নদী পর্যন্ত খুলনা জেলা এবং মধুমতী হইতে মেঘনার মোহনা পর্যন্ত বরিশাল জেলার অন্তর্গত।’ বর্তমান বাংলাদেশের খুলনা বিভাগের অন্তর্গত খুলনা, বাগেরহাট এবং সাতক্ষীরা জেলায় বিশ্বের সবচেয়ে বড়ো ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল সুন্দরবনের অবস্থান। ঊনিশ শতকের দিকে সুন্দরবনের বিস্তৃতি ছিল প্রায় ১৬,৭০০ বর্গকিলোমিটার। সঙ্কুচিত হতে হতে বর্তমানে প্রকৃত আয়তন এসে দাঁড়িয়েছে প্রায় ১০,০০০ বর্গকিলোমিটারে। ব্রিটিশ ভারত বিভাগের পর সুন্দরবনের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ পড়েছে বাংলাদেশে এবং বাকিটা ভারতে। এ হিসেবে সুন্দরবনের বাংলাদেশের অংশ প্রায় ৫৮০০ বর্গকিলোমিটার এবং ভারতের অংশ প্রায় ৪২০০ বর্গকিলোমিটার। বাংলাদেশ অংশের মধ্যে প্রায় ৪,১০০ বর্গকিলোমিটার স্থলভাগ ও ১৭০০ বর্গকিলোমিটার জলাভূমি। বালাদেশ অংশের ‘পূবর্’ ও ‘পশ্চিম’ দু’টি বিভাগের অধীনে চারটি প্রশাসনিক রেঞ্জে ভাগ করা হয়েছে সুন্দরবনকে। রেঞ্জগুলো হলো:
১. চাঁদপাই
২. শরণখোলা
৩. খুলনা
৪. সাতক্ষীরা
চারটি রেঞ্জের পাশাপাশি ১৭ টি স্টশেন, ৭২ টি টহল ফাঁড়ি ছাড়াও ব্যবস্থাপনার জন্য সুন্দরবনকে আবার ৯ টি ব্লক, ৫৭ টি কম্পার্টমেন্ট ও ১০৪ টি ইউনিটে ভাগ করা হয়েছে। বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের জন্য সুন্দরবনের তিনটি অভয়ারণ্য, সুন্দরবন পশ্চিম অভয়ারণ্য এবং সুন্দরবন মধ্য বা দক্ষিণ অভয়ারণ্য। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৩ মিটার উচ্চতায় সুন্দরবনের অবস্থান। স্টেশনগুলি যথাক্রমে সুপতি, বগি, শরণখোলা, ধান সাগর, জিউধরা, চাঁদপাই, ঢাংমারি, সুতোরখালি, কালাবাগি, নলিয়ান, বানিয়াখালি, কাশিয়াবন্দ, কবোডাক, বুড়িগোয়ালিনী, কদমতলা এবং কৈখালী। ব্রিটিশ শাসনাধীন চব্বিশ পরগণা জেলা ‘ইস্ট ইন্ডিয়া’ কোম্পানি কর্তৃক লর্ডক্লাইভের জায়গীর প্রাপ্তির পরে প্রশাসনিক সুবিধার জন্য ১৭৭০ খ্রিষ্টাব্দে ক্লড রাসেল নামক ইংরেজ কালেক্টর সমগ্র সুন্দরবনকে ১৪৪ টি লটে ভাগ করেন। এই বিভাজনের ১১ বছর পরে তদানীন্তন যশোরের ম্যাজিস্ট্রেট হেঙ্কেল সাহেব বনাঞ্চল কেটে ৫৩৬৪ কি. মি. জমি বসবাস ও চাষাবাদের উপযোগী করেন। যদিও সুন্দরবনের অন্দরমহল ৯৬৩০ বর্গ কি. মি. প্রায়। এর মধ্যেই আছে ম্যানগ্রোভ, সংরক্ষিত বনাঞ্চল, জলাভূমি এবং অন্যান্য। ১৮৭৫ খ্রিষ্টাব্দে সুন্দরবনকে সংরক্ষিত বন হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এর মধ্যে ৩২,৪০০ হেক্টর এলাকা বন্যপ্রাণীর অভয়ারণ্য হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। ১৯৯৭ খ্রিষ্টাব্দে সুন্দরবন ইউনেস্কো ঘোষিত বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় স্থান পায়। ৭৯৮তম বিশ্ব ঐতিহ্য এটি। এক হিসেব মতে সুন্দরবনে বর্তমানে প্রায় সাড়ে চারশ রয়েল বেঙ্গল টাইগার ও ত্রিশ হাজারেরও বেশি চিত্রা হরিণের বসবাস। এ ছাড়া মায়া হরিণ, বন্য শূকর, বানর, গুইসাপ, ভোঁদর, ডলফিন, লোনাপানির কুমির, কিং কোবরা, বেঙ্গল কোবরা, অজগর ইত্যাদি বন্যপ্রাণীর দেখা মেলে সুন্দরবনে। সুন্দরবনে প্রায় ৩৩০ প্রজাতির গাছপালা রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো: সুন্দরী, কেওড়া, পশুর, ধুন্দল, আমুর, গর্জন, খোলশী, বলা, হেতাল, গোলপাতা, টাইগার ফার্ন, হারগোজা ইত্যাদি। সুন্দরবনের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য জায়গার মধ্যে শরণখোলা রেঞ্জের অধীন বঙ্গোপসাগরের কোলঘেঁষে অবস্থিত জনপ্রিয় পর্যটনকেন্দ্র ১. কটকা ২. জামতলি সমুদ্র সৈকত ৩. কচিখালি অভয়ারণ্য ৪. ডিমের চর অভয়ারণ্য ৪. পক্ষীর চর ৫. তিনকোনা দ্বীপ; চাঁদপাই রেঞ্জের অধীন ১. দুবলার চর ২. করমজল ৩. লাউডুব ৪. হাড়বাড়িয়া; খুলনা রেঞ্জের অধীন ১. হিরণ পয়েন্ট ও ২. শিবসা। সুন্দরবন থেকে দক্ষিণে গভীর সমুদ্রে তিমি আর ডলফিনের এক রাজ্যের নাম সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড। ৩৮৫৮ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের সাতক্ষীরা জেলার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ জুড়ে রয়েছে সুন্দরবন। জেলার শ্যামনগর উপজেলার মুন্সিগঞ্জ ও বুড়িগোয়ালিনী ঘাট থেকে শুরু সুন্দরবনের। সুন্দরবনের অন্যান্য এলাকা থেকে এ জায়গাগুলোর ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য একটু ভিন্নতর। এ অঞ্চলের সুন্দরবনের উল্লেখযোগ্য ভ্রমণ জায়গাগুলো হলো কলাগাছিয়া, মান্দারবাড়িয়া, দোবেকী ইত্যাদি। সুন্দরবনঘেঁষা মান্দারবাড়িয়া সমুদ্রসৈকতটি বেশ আকর্ষণীয়। এ ছাড়া সুন্দরবনের এ অঞ্চলটি মধু আহরণের জন্য বিখ্যাত। বঙ্গোপসাগরের তীরে মেঘনা ও তেঁতুলিয়া নদীর মোহনায় জেগে ওঠা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি চর কুকরী-মুকরীতে রয়েছে ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল। ভোলা জেলার এই অঞ্চলটি এখন আর সুন্দরবনের অংশ হিসেবে বিবেচিত হয় না। এছাড়া চরফ্যাশন উপজেলার ঢালচর উপকুলীয় বনভূমি ও সৈকত, তারুয়া বনভূমি ও সমুদ্রসৈকত সংলগ্ন উপকূলীয় অভয়ারণ্য, মনপুরা অভয়ারণ্যও উল্লেখযোগ্য। পরিচ্ছন্ন সৈকত, সামুদ্রিক পাখি আর অভয়ারণ্যই পর্যটন সম্ভাবনাময় এ সব অঞ্চলের প্রধান আকর্ষণ। পটুয়াখালী জেলার কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতের পূর্বদিকে অবস্থিত গঙ্গামতীর মোহনায় অবস্থিত গজমতির জঙ্গলও এখন আর সুন্দরবনের অংশ নয়। কুয়াকাটা সৈকতের পশ্চিম দিকে অবস্থিত ফাতরার বন নামে পরিচিত সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল সুন্দরবন হিসেবে পর্যটকদের নিকটও জনপ্রিয়। সুন্দরবনের সকল বৈশিষ্ট্য, ঘন গোলপাতা ও সুন্দরীগাছের সমারোহ থাকলেও এ বনে কোনো হিংস্র প্রাণির বসবাস নেই।
মোগল স¤্রাট আকবরের সময়ে সুন্দরবন জরিপ ভূ-খণ্ডের আওতাভুক্ত হয় এবং সুন্দরবন পৃথক পরগনা হিসেবে অভিহিত হয়। সম্রাট আকবর তার রাজ্যকে চব্বিশটি পরগনায় বিভক্ত করেন। কলকাতা থেকে কালিন্দী পর্যন্ত অবস্থিতি ছিল চব্বিশ পরগনার। বর্তমানে উত্তর ও দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা নামে দু’টি পৃথক জেলার অবস্থিতি থাকলেও চব্বিশ পরগনা নামের কোনো শহরের উপস্থিতি নেই। স¤্রাট আকবর কর্তৃক গঠিত চব্বিশটি পরগনার মধ্যে রাজা বিক্রমাদিত্যই প্রথম সুন্দরবন নামক পরগনার সনদ প্রাপ্ত হন। বাংলাদেশের সাতক্ষীরা পূর্বে চব্বিশ পরগনার অংশ ছিল। জেলা হিসেবে যশোরের আত্মপ্রকাশ ১৭৬৯ খ্রিষ্টাব্দে। খুলনা ছিল অখ- বাংলার প্রথম মহকুমা। ১৮৪২ খ্রিষ্টাব্দে নীলকর রেনীর অত্যাচার দমন করতেই খুলনা মহকুমার সৃষ্টি হয়। ১৮৬০ -৬১ খ্রিষ্টাব্দে নীলবিদ্রোহ যখন ব্যাপক রূপ পায়, তখন যশোর জেলাকে খুলনা, ঝিনাইদহ, মাগুরা, নড়াইল ও যশোর এই কয়েকটি মহকুমায় বিভক্ত করা হয়। কয়েক বছর বাদে ১৮৮২ খ্রিষ্টাব্দে খুলনা জেলা স্থাপিত হলে চব্বিশ পরগনা থেকে সাতক্ষীরাকে পৃথক করে; খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা একত্রে খুলনা জেলা গঠিত হয়। ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে ভারত ভাগের সময় যশোর জেলার বনগাঁ ও গাইঘাটা থানাকে আধুনিক ভারতের পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগনার সাথে যুক্ত করা হয়।
৩. সুন্দরবনের নামকরণ
সুন্দরবনের নামকরণ নিয়েও নানামুখী মত রয়েছে। সুন্দরবনের সুন্দরী নামের গাছের আধিক্য রয়েছে। এর কাঠ দেখতে পরিষ্কার লাল বর্ণ, তার জন্য সুন্দর। এই কারণে একে সুন্দরী বা সুন্দর গাছ বলে। সুন্দরী গাছের সংখ্যা বেশি থাকার কারণেই এই বনের নাম হয়েছে সুন্দরবন এমন ধারণাই অধিক প্রচলিত। কেউ কেউ যুক্তি দিয়ে থাকেন অনেক স্থানে সুন্দরী গাছ নেই, অথচ সর্বত্রই একে সুন্দরবন বলে। কারো কারো মতে, এটি সমুদ্রবন শব্দের অপভ্রংশ; সাধারণ লোকে সমুদ্র বলতে সমুদ্দুর বলে থাকে। H. BLOCHMANN সুন্দরবনের নামকরণ প্রসঙ্গে বলেন, ‘The name Sundarban has been variously explained. The word has been derived from Sundar and ban, meaning a beautiful forest; or it has been looked upon as a corruption of Sundarban , Sundri forest, from sundri, a well-known timber-tree (Heretiera litiralis) which grows in vast quantities in the jungle. The reddish colour of its wood explains the name, which, although simply meaning beautiful, is perhaps connected with sindur, vermilion; and the common belief is that the wood becomes redder the more its roots are reached by the salt water.’ ব্লকম্যান আরও উক্ত করেন প্রাচীন রাজ্য চন্দ্রদীপ নাম হতে চন্দ্রীপ বন, প্রাচীন অস্পৃশ্য জাতিগোষ্ঠী; ব্রাহ্মণেরা যাদেরকে বলেছেন চহুভ-, যারা লবণ উৎপাদনের সাথে যুক্ত ছিলেন; সেই মলঙ্গদেরই অন্য নাম চ-ভ-, যাদের সম্পর্কে পরবর্তী আলোচনায় উল্লেখ হরা হবে। এই চ-ভ- থেকেই সুন্দরবনের নামকরণ হতে পারে। সুন্দরবন নামটি অপেক্ষাকৃত আধুনিক বলে তিনি মত পোষণ করেন। নয়নাভিরাম বা সুন্দর যে বনভূমি, তাকেই মানুষ ভালোবেসে নাম দিয়েছে সুন্দরবন। স্বাভাবিক দৃষ্টিতে এই ব্যাখ্যাটিকে বেশ যৌক্তিক মনে করাও অস্বাভাবিক নয়। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মাধ্যমে তিস্তার মহাপ্লাবন থেকে যে যমুনা নদীর সৃষ্টি হয়েছিল তার তীরবর্তী নদী-খাল বিধৈৗত বর্তমান বাংলাদেশের গাইবান্ধা জেলার একটি থানার নাম সুন্দরগঞ্জ। সুন্দর যে বসতি, নগর বা পুর তাকেই ভালোবেসে মানুষ একদিন নাম দিয়েছিল সুন্দরগঞ্জ। তেমনি সুন্দর বনভূমির নাম সুন্দরবন হওয়া বিসদৃশ নয়। অতীতের বঙ্গভূমির গঠন উত্তর থেকে বিস্তৃত হতে হতে দক্ষিণে এগিয়েছে, জেগেওঠা চরে বনভূমি গড়ে উঠেছে, মানুষ বসতি স্থাপন করেছে। সমুদ্র সরে গেছে ক্রমশঃ দক্ষিণে। এভাবেই চলেছে গাঙ্গেয় বদ্বীপের গঠন, বন সরে গেছে দক্ষিণে, পুনরায় জনবসতি গড়ে উঠেছে, সমুদ্র চলে গেছে আরও দক্ষিণে। এভাবেই লক্ষ লক্ষ বছর ধরে চলেছে গাঙ্গেয় উপত্যকার গঠন ও সুন্দরবনের সমুদ্র বিলাস। প্রবন্ধের পরবর্তী অংশে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে। চীনদেশীয় পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙ (খ্রিঃ অঃ ৬৩৬-৬৪৬ খ্রিঃ অঃ) যখন ভারত-ভ্রমণ করেন, তখন গৌড় অতীব সমৃদ্ধ নগর ছিল। তিনি জলপথে বাকলা, কামরুপ এবং আরাকান পর্যন্ত ভ্রমণ করতে মনস্থ করেছিলেন; তৎকালে গেদর নগরের পূর্বভাগ জলমগ্ন ছিল। সুতরাং উপযুক্ত নৌযানে তাকে কামরুপ বা আসাম যেতে হয়েছিল। অতি প্রাচীনকালে বাকলাতে সুগন্ধা নামে এক নদী প্রবাহিত ছিল, কবি ভারতচন্দ্র রায় গুণাকরের অণ্নদা মঙ্গল কাব্যে সুগন্ধা নদীর নাম উক্ত আছে। পতিনিন্দা শুনে জগৎ মাতা দাক্ষায়ণী প্রাণ ত্যাগ করলে, স্ত্রী শোকে মুহ্যমান ভগবান মহাদেব সতীর মৃতদেহ কাঁধে করে চতুর্দিকে ভ্রমণ করতে লাগলেন। তা দেখে মহাভাগ বিষ্ণু চক্র দ্বারা সেই দেহ একান্ন খ-ে বিভক্ত করেন। যে যে স্থানে সেই খ-গুলি পরেছিল, সে সে স্থান এক একটি পীঠস্থান। কথিত আছে উল্লেখিত নদীর স্থানে দেবীর নাক পড়েছিল, সম্ভবত, সেই জন্যই নদীর নাম হয়েছে সুগন্ধা। রায়গুণাকরের পীঠমালায় রয়েছে:
সুগন্ধায় নাসিকা পড়িল চক্রহতা।
ত্রম্বক ভৈরব তাহে সুনন্দা দেবতা।।
সুগন্ধা হতে সুনন্দা > সুন্দা > সন্ধ্যা অর্থাৎ সন্ধ্যা নদীর থেকে সুন্দরবনের নামকরণের প্রসঙ্গটিও কেউ কেউ ধারণা করে থাকেন। পা-ব বর্জিত, নীচ জাত মানুষের বসতি স্থাপনের জন্য ব্রাহ্মণ্যবাদীরা চিরকালই বঙ্গভূমির এই ভাটি অঞ্চলকে অস্পৃশ্য জ্ঞান করেছেন। কিন্তু তাতে সুন্দরবনের সৌন্দর্যহানি এক কানা কড়িও হয়নি। ভূমিকম্প, ঝড়, জলপ্লাবন, সাইক্লোন প্রভৃতি দৈব-দূর্বিপাক সহ্য করে সুন্দরবন বঙ্গভূমিকে সুরক্ষা দিয়েছে প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকেই। ধ্বংসের মাঝে আবার নতুন করে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে, সুন্দরের নয়নাভিরাম শোভায় নতুন করে ভরে দিয়েছে সাগরকূল; সুন্দরবন এ কারণেই চিরকাল সুন্দর। তার মাহাত্ম্য এখানেই।
১৮৯৫ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত খোসালচন্দ্র রায়ের বাকরগঞ্জের ইতিহাস গ্রন্থে সুন্দরবন সম্পর্কে চমকপ্রদ বর্ণনা লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। তিনি সুন্দরবনের পূর্ববর্তী নাম মুরাদখানা বা জিরাদখান বলে উল্লেখ করেছেন। সুন্দরবনের ঐতিহাসিক, ভৌগোলিক, সামাজিক-সাংস্কৃতিক সার্বিক বিষয়াদি নিয়ে অতি সংক্ষেপে এমন প্রাঞ্জল বর্ণনার দক্ষতা অতি অল্পসংখ্যক লেখকের মাঝেই দেখা যায়। বাকরগঞ্জের ইতিহাসে লিখিত আছে, “সুন্দরবন প্রকৃতির অতি রমণীয় স্থানে অবস্থিত। এ প্রদেশের প্রায় সম্পূর্ণ ভাগই গভীর অরণ্যে আবৃত। সম্মুখে অনন্ত সমুদ্র সর্বদা বিশালভাবে পরিপূর্ণ হইয়া অরণ্যের পাদদেশ বিধৌত করিতেছে, যতদূর দৃষ্টিপাত করা যায়, ততদূরই কেবল অপার ও অনন্ত বারিবাশি দৃষ্টিপথে পতিত হয়। উপরের অনন্ত আকাশ, সম্মুখে নীল সমুদ্র, মধ্যভাগে মনোহর বৃক্ষ ও গভীর অরণ্য, স্থানে স্থানে পরিষ্কার সমভূমি ও লোকালয় দৃষ্ট হয়। উপকূল হইতে বহুদূরব্যাপী সমুদ্রের গভীরতা অতি অল্প। বালুকা ও কর্দম পতিত হইয়া জমির পরিমাণ বৃদ্ধি করিতেছে। হরিণঘাটা মোহনার দেড়শত মাইল দক্ষিণেই সমুদ্র অত্যন্ত গভীর। বনে ব্যাঘ্র, মহিষ, হরিণ, শূকর ও অন্যান্য অসংখ্য হিং¯্র জন্তুও বসতি স্থান আছে। মধ্য দিয়া বড়ো বড়ো নদী ও খাল চারিদিকে বিস্তৃত রহিয়াছে। জোয়ারের জল স্ফীত হইয়া তীরস্থ অরণ্য স্পর্শ করে। এ দেশে অন্যান্য বৃক্ষ অপেক্ষা সুন্দর বৃক্ষ অধিক বলিয়াই “সুন্দরবন” নাম হইয়াছে। সুন্দরবনের পুরাতন নাম মুরাদখানা বা জিরাদখান। বাকরগঞ্জের সুন্দরবন বিভাগ, আমতলী ও পিরোজপুরের অন্তর্গত। মধ্যে মধ্যে আবাদ হইতেছে। স্থানে স্থানে পূর্বের আবাদি স্থানের পরিমাণই বৃদ্ধি পাইতেছে। বাকরগঞ্জ জেলার সুন্দরবন প্রায় এগারো আনি আবাদ হইয়াছে। যে সকল বৃক্ষ ও জঙ্গল কাটা হয় সেগুলি আমতলী, গুলিসাখালি, ঝালকাঠি, ফুলঝুরি, বাকরগঞ্জ, নলছিটি, বরছাকাঠি, বরিশাল প্রভৃতিস্থানে বিক্রয়ার্থ প্রেরিত হইয়া থাকে। ১৮১৬ খ্রিষ্টাব্দে যুগারী নামে জনৈক মগ, ২৩০ ঘর প্রজাসহ সুন্দরবনে উপস্থিত হইয়া তথাকার জঙ্গল আবাদ করত বসতি করিতে আরম্ভ করে এবং তথায় বহুল পরিমাণ শস্য উৎপণœ করাইতে থাকে। যুগারী একজন ধনী বলিয়া প্রসিদ্ধ। মঘাইটাটি সুপারির কারবাওে তাহার যথেষ্ট ধন সঞ্চয় হইয়াছিল। তাহার এলাকাধীন লবণের কারখানা ছিল। গুলিসাখালির অধীন খাপরাভাঙ্গা, মৌডুবী, বড়বগী, ছোটবগী, লতাচাপলী, কচুপাতরা, টিয়াখালি, তান্তুপাড়া, কুয়াকাটা প্রভৃতি স্থানে মগ জাতি বাস করে। তদ্ভিন্ন কুকরী মুকড়ী দ্বীপেও তাহাদিগের উপনিবেশ লক্ষিত হয়। ইহারা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। এ জাতি অত্যন্ত সরল ও সত্যনিষ্ঠ। ইহাদিগের সংখ্যা ৬০৮০। এই প্রদেশ পূর্বে কোনো পরগনাভুক্ত না থাকায়, কোনো জমিদারের অধিকারে ছিল না। সুন্দরবনের শাসনকার্য নির্বাহ করার জন্য একজন কমিশনার নিযুক্ত আছেন। বাসনা, হালটা, সোনাখালি, আয়লা ও ফুলঝুরি এখন আর গভর্নমেন্টের খাস সম্পত্তির অন্তর্গত নহে। উক্ত মহালগুলির রাজস্ব বিষয়ক চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত হইয়া ১৩৪০৯৮ টাকা বার্ষিক ধার্য হইয়াছে।”
সতীশচন্দ্র মিত্রের ভাষায়, ‘বঙ্গোপসাগর ক্রমশঃ দক্ষিণে সরিতেছে। সমুদ্রকূলবর্তী স্থানসকল প্রথমতঃ নিম্নচর থাকে, সেখানে সমুদ্রের জল উঠে ও জঙ্গল জন্মে। ক্রমে স্থান উচ্চ হইয়া যত আরও চরভূমি জাগে, সমুদ্র তত সরিয়া যায়। উপরের জঙ্গলে মানুষর বসতি হয় এবং নিম্নচরে পুনরায় বন প্রস্তুত হইতে থাকে। এইভাবে সমুদ্র ক্রমশঃ দক্ষিণদিকে অর্থাৎ হিমালয়ের পাদদেশ হইতে দূরে সরিতেছে। সমুদ্রের কূলে নিম্নচর, তাহার উপরে জঙ্গলাকীর্ণ চর এবং তাহার উপরে মানুষের বসতি; এইভাবে চর ও জঙ্গল সমুদ্রকূলের চিরসঙ্গী। হিমালয়ের পাদদেশ অতিক্রম করিয়া দক্ষিণে অগ্রসর হইলেই সমুদ্রের অস্তিত্বেও প্রমাণ পাওয়া যায়। নেপাল রাজ্যের নিম্নদেশে গঙ্গাপ্রবাহের উভয় পাড়ে এক ভীষণ অরণ্য ছিল, উহার নাম চম্পারণ্য। এখন উহা চম্পারণ্য জেলা। এই চম্পারণ্যের মধ্য দিয়াই গ-কী বা সদানীরা নদী প্রবাহিত। যখন চম্পারণ্য ভীষণ জঙ্গল ছিল, তখন তাহারই নি¤েœ এক বিস্তৃত চর পড়িতেছিল। ঐ চর হইতেই বিদেহ বা মিথিলার উৎপত্তি হয়। বিদেহ যে পূর্বকালে সমুদ্রকূলে ছিল, তাহা ইহার তীরভূক্তি নাম হইতে স্পষ্ট বুঝা যায়। বেদে উক্ত হইয়াছে যে প্রদেশ জলে মগ্ন হইত। সুতরাং মিথিলা তখন সুন্দরবনের মত নি¤œস্থান ছিল। মিথিলার বিস্তৃতি ছিল গণ্ডকী হইতে কৌশিকী পর্যন্ত। ক্রমে মিথিলা উন্নত হইলে, তথায় লোকের বসতি হয়। মহাভারতের স্থানে স্থানে বঙ্গরাজ এবং বঙ্গদেশের উল্লেখ পাওয়া যায়। সভাপর্বের দিগি¦জয় অধ্যায়ে রাজসূয় যজ্ঞকালে পা-বগণ যে যে স্থান জয় করেছিলেন তার উল্লেখ পাওয়া যায়। মহাবীর ভীমসেন মগধ জয় করার পরে বঙ্গদেশ জয় করেন এবং রাজন্যবর্গ ও ম্লেচ্ছদের পরাজিত করে কর গ্রহণ করেছিলেন। যথা:
“উভৌ বলবৃতৌ বীর্যাবুভৌ তীব্রপরাক্রমৌ।
নির্জিত্যাজৌ মহারাজা বঙ্রাজমুপাদ্রবৎ।।
সমুদ্রসেনং নির্জিতা চন্দ্রসেনঞ্চ পার্থিবম॥
তা¤্রলিপ্তঞ্চ রাজানং কর্বটাধিপতিং তথা।
সুহ্মানামধিপঞ্চৈব যে চ সাগরবাসিনঃ।
সর্বান্ ম্লেচ্ছগণাংশ্চৈব বিজিগ্যে ভরতর্ষভ।।
এবং বহুবিধান্ দেশান, বিজিত্য পবনাত্মজঃ।
বসু তেভা উপাদায় লৌহিত্যমগমদ্বলী।।
স সর্বান্ ম্লেচ্ছনৃপতীন্ সাগরানুপবাসিনঃ।
করমাহরয়ামাস রপ্তানি বিধানি চ”।।
অর্থাৎ এই দুই পরাক্রান্ত রাজাদের (পৌণ্ড্রাধিপতি ও কৌশিকী কচ্ছনিবাসী রাজা) সংগ্রামে বিজিত করিয়া বঙ্গরাজের প্রতি ধাবমান হইলেন, মহারাজ সমুদ্রসেন, চন্দ্রসেন, তাম্রলিপ্তিরাজ কর্বটাধিপতি, সুহ্মাধিপতি প্রভৃতিকে জয় করিয়া সমুদয় ম্লেচ্ছ জাতিকে পরাভূত করিলেন। মহাবল পবননন্দন এমনরূপে বঙ্গদেশ বিজয় ও সর্বত্র ধন সংগ্রহ পূর্বক সাগরতীরবাসী সমস্ত ম্লেচ্ছগণকে পরাজিত করিয়া নানাবিধ ধনরত্ন এবং কর সংগ্রহপূর্বক লৌহিত্যদেশে (ব্রহ্মপুত্র তীরে) উপস্থিত হইলেন। সংস্কৃত অভিধানে ম্লেচ্ছ শব্দের অর্থ যবন, কিরাত, শবর, পুলিন্দ প্রভৃতি জাতিকে বোঝায়। অপভাষী, কদাচার, সর্বধর্মরহিত, ক্রিয়াকা-হীনরাই ব্রাহ্মণদের চোখে ম্লেচ্ছ। বঙ্গদেশকে ম্লেচ্ছদেশ উল্লেখ করে, লিখিত হয়েছে:
‘চাতুব্বর্ণব্যবস্থানাং যসিম্মন্ দেশে ন বিদ্যতে।
ম্লেচ্ছদেশঃ স বিজ্ঞেয় আর্য্যাবর্তস্ততঃ পরম।।
অর্থাৎ যে দেশে চতুর্বর্ণের ব্যবস্থা নেই, অধিবাসীগণ শিষ্টাচাররহিত এবং অসংস্কৃতভাষী, অর্থাৎ অপভাষা ব্যবহার করে তাহাই ম্লেচ্ছদেশ। ভাষাভিত্তিক বর্ণভেদ প্রথার নির্মম কষাঘাতে প্রাচীন বঙ্গ-ভারত কীরূপ জর্জড়িত ছিল, উপরোক্ত পংক্তিমালায় তা পরিষ্কারভাবে ফুটে উঠেছে। সংস্কৃত ভাষায় যারা কথা বলতে পারে না, তারাই ম্লেচ্ছ বা চণ্ডাল। বাংলাদেশের দক্ষিণ অঞ্চলে বসবাসরত চণ্ডভণ্ড নামক নীচ জাতীয় সাগরকূলবর্তী বাসিন্দাদের মধ্যে যারা লবণ চাষের সাথে যুক্ত ছিলেন, তাদের বলা হতো মলঙ্গ। বর্ণভেদ প্রথায় এদেরকে বলা হতো চণ্ডাল। অর্থাৎ পুরাণে বর্ণিত ম্লেচ্ছ, তাম্রশাসনে উৎকীর্ণ চণ্ডভণ্ড এবং বর্তমান চণ্ডাল গোষ্ঠীর মানুষকে একই অর্থে সম্বোধন করা হয়েছে। ১৯১৫ খ্রিষ্টাব্দে কীর্তিপাশা নিবাসী শ্রীসুধাংশু কুমার কর্তৃক প্রকাশিত, রোহিনীকুমার সেন রচিত ‘বাকলা’ (বাকরগঞ্জের প্রত্নতত্ত্ব ও আধুনিক ইতিহাস) নামক গ্রন্থে নিম্নবর্গের শ্রেণি-পেশা-বর্ণের মানুষ সম্পর্কে বলা হয়েছে এরা উদ্ধত, ক্রিয়াকা- বর্জিত, দুশ্চরিত্র এবং ধর্মাচরণ বিরহিত।
৪. সুন্দরবনের উৎপত্তি
সুন্দরবন ও বঙ্গভূমির গঠনের সাথে হিমালয়ের উৎপত্তির সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে। হিমালয় পৃথিবীর নবীনতম, সর্বোচ্চ এবং উপমহাদেশের সর্বপ্রাচীন পর্বতমালা। রহস্যে ঢাকা হিমালয় পর্বতমালাকে ঘিরে অসংখ্য মিথ ও পৌরাণিক কাহিনি তৈরির প্রাচুর্যের মতোই হিমালয়ের উৎপত্তির ইতিহাসও বৈচিত্র্যময় প্রাকৃতিক ঘটনায় সিঞ্চিত। মানুষের ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতি সম্পর্কে জ্ঞানার্জনের জন্য ভূ-তাত্ত্বিক, ঐতিহাসিক, নৃতাত্ত্বিক এবং ফোকলোরবিদের মধ্যে চিন্তার সমন্বয় থাকা জরুরি। অতীত ইতিহাসের মানুষের জীবনধারা ও সাংস্কৃতিক গতিশীলতা পরস্পরের পরিপূরক। ভৌগোলিক অবস্থান, মানুষের জীবনাচার, রীতি, চিন্তন-প্রণালি, নিয়মাবলী, বিশ্বাস-সংস্কার, উৎসব-পার্বণ, ভাষা, সাহিত্য, শিল্পকলা, মূল্যবোধ ও চৈতন্যকে প্রভাবিত করে। সুন্দরবনের ক্ষেত্রেও তার ব্যত্যয় ঘটতে পারে না। ‘ভূ-তত্ত্ববিদগণের মতে সুন্দরবন অঞ্চল সম্প্রতি সমুদ্র হইতে শির উত্তোলন করিয়াছে। কিন্তু ভূ-তত্ত্ববিদগণের এই “সম্প্রতি” র অর্থ লক্ষ লক্ষ বৎসর, Ñ সুতরাং ঐতিহাসিক আলোচনার সময় তাঁহাদের মতামত ধর্তব্যের মধ্যে নহে’। সুন্দরবন বাংলার দক্ষিণ প্রান্তে বঙ্গোপসাগরের তীর ঘেঁষে গড়ে উঠেছে। কিন্তু এই সাগর ক্রমশঃ দক্ষিণে সরে গেছে। বর্তমান আলোচনায় আমরা সেই দিকটিকেই স্পষ্ট করবো।
প্রথমেই হিমালয়ের উৎপত্তিজনিত প্রভাবের অনিবার্য ফল হিসেবে বঙ্গভূমির গঠনের দিকটি নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে। ভৌগোলিক, নৃতাত্ত্বিক ও সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে বাংলা স্বাতন্ত্র্যের দাবিদার। সমগ্র বাংলাই সরাসরি হিমালয় পর্বত দ্বারা প্রভাবিত। হিমালয় এ জনপদের জন্য আশির্বাদ। প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকেই এ অঞ্চলের প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য এর জনজীবনকে সরাসরি প্রভাবিত করে আসছে। দক্ষিণের বঙ্গোপসাগর, ভারত মহাসাগর এবং আরব সাগর থেকে বাষ্পরাশি মেঘ আকারে আকাশে উত্থিত হয় এবং বায়ু তাড়িত হয়ে রাশি রাশি মেঘ বাংলার উপর দিয়ে উত্তর দিকে অগ্রসর হয়ে, হিমালয় পর্বতে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে প্রচুর বৃষ্টিপাত ঘটায়। মেঘেদের বিপুল অংশ হিমালয়ে বরফ আকারে জমা হয়ে থাকে। গ্রীষ্মকালে বরফগুলো ধীরে ধীরে গলতে শুরু করে। বরফগলা জল¯্রােত নি¤েœ প্রবাহিত হয়ে সমগ্র বাংলাদেশেই ব্যাপক বন্যা ঘটায়। এ দেশের অধিকাংশ নদ-নদীই হিমালয় থেকে উৎপত্তি লাভ করেছে। হিমালয়ের উৎপত্তির ইতিহাসও আমাদের আলোচনার বাইরে নয়। বর্তমান হিমালয় ও আল্পস পর্বত অতীতে এভাবে ছিল না। তখন এই পর্বতের স্থানে ছিল বিশাল সমুদ্র। নাম ছিল টেথিস। টেথিসের দুপাশে ছিল দুটি প্রাচীন মহাদেশ। উত্তরের মহাদেশটির নাম ছিল অঙ্গারল্যান্ড এবং দক্ষিণের মহাদেশটির নাম ছিলো গন্ডোয়ানা। অভ্যন্তরীণ শক্তিজনিত কারণে মহাদেশ দু’টি পরস্পরের কাছাকাছি আসতে চাইলো। পরস্পরের প্রতি চাপ বাড়তেই থাকলো। বেচারা টেথিস মহাসাগর তখন পালিয়ে বাঁচতে চাইলো। পথ না পেয়ে নিচের দিকে বসে গেলো। পরস্পরের পার্শ্বচাপে উভয় মহাদেশের ক্ষয় হতে থাকলো। সংঘর্ষ বেড়েই চললো। টেথিস মহাসাগর তখন ভূ-অভ্যন্তরস্থ সঞ্চিত লাভা এবং পাললিক শিলারাশি উপর দিকে নির্গত করতে শুরু করলো। গরম শিলারাশি আকাশ ছুঁতে চাইলো। ধীরে ধীরে ঠা-া হয়ে পর্বতের আকার ধারণ করলো। এভাবে উৎপত্তি হলো আল্পস এবং হিমালয় পর্বতের। প-িতেরা ধারণা করেন পূর্ববর্তী সংঘর্ষের জের এখনও বর্তমান। তাই অঙ্গারল্যান্ড অংশ বা এশিয়া পাত এবং গন্ডোয়ানাল্যান্ড অংশ বা ভারতীয় পাত প্রতিবছর ৭-৯ কিলোমিটার এবং ১০-১৫ কিলোমিটার করে উত্তর-পূর্বদিকে এগিয়ে চলেছে। ফলস্বরূপ হিমালয় পর্বত ক্রমশ উঁচু হচ্ছে। ভূ-তত্ত্ববিদরা ধারণা করেন, গন্ডোয়ানাল্যান্ডের বয়স সম্ভবত ২২.৫ কোটি থেকে ৩৫ কোটি বছর। এই সময় থেকেই সাগর দক্ষিণ দিকে সরে আসতে থাকে এবং ভূমি পুনর্গঠন প্রক্রিয়া শুরু হয়। হিমালয় পর্বতের উৎপত্তির পর উৎক্ষিপ্ত আগ্নেয় শিলাবাহী স্রোতের ধারা নিম্নগামী হতে শুরু করে। পরবর্তীকালে ২২ থেকে ৭ কোটি বছর আগেকার এই মেসোজয়িক শিলারাশির তলানি, তাপ, চাপ ও হিমালয়সৃষ্ট কারণে কয়লায় রূপান্তরিত হয়।
বাংলাদেশের ভূমি গঠন প্রসঙ্গে আবুল কালাম মোহাম্মদ জাকারিয়া তাঁর বরেন্দ্র অঞ্চল বা রাজশাহী বিভাগের ভৌগোলিক ও ভূ-তাত্ত্বিক পরিচিতি প্রবন্ধে এ বিষয়ে চমৎকার আলোচনা উপস্থাপন করেছেন। সমগ্র বাংলাদেশের ভূমির নিচেই রয়েছে চুনাপাথর। প-িতবর্গ ধারণা পোষণ করেন যে, টেথিয়ান ভূ-আন্দোলনের ফলে হিমালয় পর্বত উচ্চতায় বাড়তে থাকায় বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিম কোণের অতি সামান্য ও সংকীর্ণ অংশ ব্যতীত সমগ্র বাংলাদেশ দক্ষিণ দিক হতে আগত সমুদ্র দ্বারা জলমগ্ন হয়। হিমালয়ের বিবিধ জলধারা বাহিত পলল দ্বারাই বাংলাদেশের ভূমি গঠিত হয়েছে। বাংলাদেশের গঠনই নদীতাত্ত্বিক। সমগ্র বাংলা অঞ্চলের ভূমিরূপ ও মৃত্তিকা, বৃক্ষলতা, ইতিহাস, ঐতিহ্য নদীর সাথেই সম্পৃক্ত। নদীর উৎপত্তির সাথে সাথে বাংলার ভূমি কোথাও উঁচু আবার কোথাও নিচু হয়েছে। আইনুন নিশাত এবং মনির”জ্জামান খানের ভাষায়, “বাংলাদেশের মানচিত্রে একটি কৌতুহলোদ্দীপক তথ্য রয়েছে, আর তা হলো চট্টগ্রামের পাহাড়ি অঞ্চল, ময়নামতি-লালমাই অঞ্চল, মধুপুর গড় এবং বরেন্দ্রভূমি মোটামুটি একটি কৌণিক রেখায় অবস্থিত। এদেশের অধিকাংশ নদী এসব উচ্চভূমির সংযোগহীন এলাকার সমভূমি দিয়ে প্রবাহিত। মধুপুরের পূর্বে রয়েছে সিলেটের হাওড় এবং বরেন্দ্রভূমির দক্ষিণ-পূর্বে রয়েছে চলনবিল। ভূ-তাত্তিকদের ধারণা মতে আনুমানিক বিশ-বাইশ কোটি বৎসর পূর্বে এ অঞ্চলটি সমুদ্রে নিমজ্জিত ছিল। হিমালয়ের পলি জমে স্তরে স্তরে গড়ে উঠেছে এ ভূখন্ড। এই নদীগুলোই এদেশের প্রাণ। এরাই বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলের ভূমি গঠন নিয়ন্ত্রণ করেছে, সেইসাথে নদীগুলোও বিভিন্ন সময় গতিপথ পরিবর্তন করে চলেছে। উল্লেখ্য যে, মাত্র তিনশত বৎসর পূর্বে বর্তমান যমুনা নদী একটি ছোট্ট ¯্রােতধারায় প্রবাহিত হত। সেকালের পুরাতন ব্রহ্মপুত্রই আজকের যমুনা নদী। অপরদিকে গঙ্গা নদীর নতুন শাখাই আজকের পদ্মা। কেউ কেউ অনুমান করেন যে, পদ্মা ও যমুনার মধ্যবর্তী ব্যাপক এলাকা তিস্তা, করতোয়া, আত্রাই, মহানন্দা, কোশীর মতো ছোটো ছোটো নদীর বদ্বীপ গঠন প্রক্রিয়ার দ্বারা সৃষ্ট হয়েছে। আইনুন নিশাত এবং মনিরুজ্জামান খান এই মতের বিরোধিতা করেন। তারা যুক্তি দেখিয়েছেন যে, গঙ্গার মতো বিশাল নদী অতীতে বরেন্দ্র অঞ্চলটির উপর দিয়ে প্রবাহিত না হলে পুরো বরেন্দ্র এলাকাই চলনবিলের মতো নিচু ভূমিতে পূর্ণ থাকতো। বরেন্দ্রভূমি গঠনের সাথে সাথে গঙ্গ নদী দক্ষিণ দিকে সরে যেতে থাকে। বিশেষজ্ঞদের ধারণা- চলনবিল অঞ্চলের মধ্যবর্তী এলাকা এ কারণেই নিচু। গঙ্গা নদী দক্ষিণে সরে যাওয়ার কারণে চলনবিল ও ময়মনসিংহ সিলেট অঞ্চলের হাওর এলাকার ভূমি গঠন অপূর্ণ থেকে যায়। গঙ্গা নদীর দক্ষিণমুখী প্রবাহ সম্ভবত খ্রীষ্টিয় এক হাজার বৎসর পূর্বের ঘটনা।
পূর্বে একথা বলা হয়েছে যে, হিমালয়ের জলধারা বাহিত পলল দ্বারাই বাংলাদেশের ভূ-প্রকৃতি গঠিত। প্রায় ২.৫ কোটি বৎসর পূর্বে সমগ্র বাংলাদেশ পুনরায় সাগরতলে নিমজ্জিত হয়। কালক্রমে হিমালয় পর্বত বাহিত পললরাশি বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় উঁচু ভূমি গঠন করে । ধারণা করা হয় যে, এই পললের পরিমাণ ছিল প্রায় ৩০,০০০ হাজার ফুট। সিলেট, চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমি এই পলল দ্বারাই গঠিত। বাংলাদেশের মধ্যে এই এলাকাই সর্বপ্রথম সমুদ্রের বুকে মাথা তুলে দাঁড়ায় এ কথা অনুমান করা যায়। পরবর্তীকাল ১.২ কোটি বৎসর পূর্বে প্লাইওসিন যুগে বাংলাদেশ ভূখ- সমুদ্র থেকে জেগে উঠে এবং উপমহাদেশীয় প্রাকৃতিক অবস্থার সাথে এক হয়ে যায়। ভূ-তত্ত্ববিদরা মনে করেন পদ্মা নদীর উত্তর তীরে অবস্থিত বরেন্দ্র অঞ্চলের নুড়ি পাথর, বালি এবং মধুপুর কাঁদা মাটি নামে পরিচিত মাটি প্লাইওসিন যুগেরই প্লাবনঘটিত অবদান। আবুল কালাম মোহাম্মদ জাকারিয়া মত পোষণ করেন যে, বাংলাদেশের ভূমি গঠনের যে বাহ্যিক বৈশিষ্ট্য বর্তমান, তা প্লাইওসিন যুগের শেষ দিক থেকে শুরু হয়েছে। সম্ভবত ১.২ কোটি বৎসর পূর্বে সমগ্র বাংলাদেশ সমুদ্র থেকে জেগে ওঠেনি। মাত্র দু’হাজার বছর পূর্বেও চলনবিল সমুদ্র গর্ভে বাস করত। বঙ্গোপসাগর যদিও তখন হিমালয় থেকে দক্ষিণে সরে এসেছে তবুও মহাস্থানগড় পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। ধীরে ধীরে বঙ্গোপসাগর আরও দক্ষিণে সরে যেতে থাকে। এক পর্যায়ে ভূমির অপূর্ণ গঠন নিয়ে চলনবিলের মতো নিচু এলাকাসমূহ জলমগ্ন হয়ে পড়ে থাকে। তখন সমুদ্রের সাথে সম্পর্ক শেষ প্রায়। সম্ভবত তখনও পদ্মা ও যমুনার নামকরণ হয়নি। অতীতের গঙ্গা এবং ব্রহ্মপুত্র চলনবিলকে ঘিরে থাকতো। গঙ্গা নদীর যে স্থান হতে ভাগিরথী প্রবাহিত, তার অপেক্ষাকৃত নি¤œ পূর্বগামী শাখা পদ্মা এবং ব্রক্ষপুত্রের পশ্চিমগামী শাখা চলনবিল দিয়েই প্রবাহিত হতো।
ইতিপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে যে, অতীতে সমগ্র বাংলাদেশ সাগর বাসিন্দা ছিল। এদিকে হিমালয় পলল বাহিত হয়ে বাংলাদেশের ভূখ- ক্রমেই জাগতে থাকে এবং বঙ্গোপসাগরও দক্ষিণে পালাতে থাকে। কিন্তু অন্যান্য এলাকার ভূমি গঠন সম্পন্ন হলেও চলনবিল ও হাওর এলাকার ভূমি গঠন ছিল অপূর্ণ। উল্লেখ্য যে, ভূমি পূর্নগঠনের প্রক্রিয়া ২২.৫ কোটি থেকে ৩৫ কোটি বৎসর পূর্বেই শুরু হয়েছিল। পরবর্তীকালে ২.৫ কোটি বৎসর পূর্বে বাংলাদেশ পুনরায় সাগর গর্ভে তলিয়ে যায় এবং ১.২ কোটি বৎসর পূর্বে জেগে উঠে। এভাবে বারবার বাংলাদেশ সমুদ্রগর্ভে তলিয়ে গেছে এবং জেগে উঠেছে। ২২.৫ কোটি থেকে ৩৫ কোটি বৎসর পূর্বের গন্ডোয়ানা যুগে বাংলার ভূমি গঠন প্রক্রিয়া শুরু হলেও হাওর এবং বিলের ভূমি গঠন ছিল অপূর্ণ। কালক্রমে সমগ্র বাংলাদেশ জাগলেও বিল-হাওর এলাকাগুলো জলমগ্ন থাকতো। কারণ, ভূমি গঠনের অপূর্ণতা তখনও ছিল। এদিকে সাগর চলেছে দক্ষিণে। কিন্তু বরেন্দ্রভূমির বিশাল অংশ চলনবিলের এই নিচু এলাকার সাথে যুক্ত ছিল ছোটো বড়ো বেশ কিছু নদী। নদীর সংযোগের কারণে চলনবিলের পানি সবসময় চলমান থাকতো। একদিকে বিশাল ভূ-ভাগ জলমগ্ন, অন্যদিকে সমুদ্রেরই একটা ফেলে যাওয়া অংশে তখন সমুদ্র্রের মতো ¯্রােতধারা বইছে। প্রাচীনকালে উরিষ্যা অঞ্চলে চোল রাজবংশ এবং চোল সমুদ্র বা ঈযড়ষধ খধশব ছিল বলে প্রাচীন ভারতের ইতিহাসে উল্লেখ রয়েছে। কাজেই চোলা রাজবংশ বা ঈযড়ষধ খধশব থেকেও চলনবিলের নামকরণ হতে পারে। চোল রাজবংশ সমুদ্র উপকূল পর্যন্ত রাজত্ব করত। তাদের ছিল শক্তিশালী নৌসেনা। আমরা আগেই জেনেছি সমগ্র মহাস্থানগড় পর্যন্ত অঞ্চল সাগরে নিমজ্জিত ছিল দুই হাজার বছর আগেও। আজকের চলনবিল আর অতীতের চলনবিলের মধ্যে যথেষ্ট পার্থক্য রয়েছে। কারণ, অতীতে চলনবিল অনেক বিস্তৃত ছিল। তৎকালীন চলনবিলকে ‘চোল সমুদ্র’ বলতে দোষের কিছু দেখিনা। কারণ সমুদ্রেরই একটি অংশ চলনবিল অন্যান্য নিচু এলাকা। হিমালয়ের উৎপত্তিজনিত শিলাময় ভস্মরাশির জলধারা বাহিত পলল যদি চলনবিল এলাকা দিয়ে গন্ডোয়ানা যুগে বাহিত হতো, তাহলে আজকের চলনবিলের কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যেতনা। এখানে গড়ে উঠত পর্বত মহাপর্বত।
আজ চলনবিল অনেক ছোটো হয়ে গেছে, কিন্তু বর্ষাকালে চলনবিল উগ্রমূর্তি ধারণ করে। নদী,খাল, জোলা, খাড়িসমূহ চলনবিলকে এমনভাবে বেঁধে আছে যে, স্বাভাবিকভাবেই বর্ষাকালে এর জলরাশিতে স্রোত বয়। আর এই স্রোতের চলমানতার কারণেই চলনবিল নামকরণ করা হয়েছে- এ তথ্যটিও বেশ যুক্তিসঙ্গত। খ্রীষ্টিয় তৃতীয় শতাব্দীর মানচিত্রে আছে - উত্তরে মহাস্থানগড়, দক্ষিণে ঢাকার বিক্রমপুর ও চট্টগ্রাম ব্যতীত সমগ্র বাংলাদেশ জলমগ্ন। চীনদেশীয় পর্যটক হিউয়েন সাঙ ভারত এসে দশ বৎসর অবস্থান করেন। তাঁর লিখিত বিবরণ থেকে ধারণা করা হয় যে, সপ্তম শতাব্দীতে চলনবিল গঙ্গা ও ব্রক্ষ্মপুত্র নদীর সঙ্গমস্থলে অবস্থান করতো। উল্লেখ্য যে, তিনি পুণ্ড্রবর্ধন হতে বিরাট নদী অতিক্রম করে আসামের কামরুপ রাজ্যে প্রবেশ করেছিলেন। ÒFrom Pundravardhan ... proceed for 900 li or 150 miles to the east and crossing a great river, kimleupo or kamrup.” পণ্ডিতগণ ধারণা করেন খ্রীষ্টিয় তৃতীয় শতাব্দীতে চলনবিলের উঁচু এলাকাসমূহে বসতি শুরু হয়। যুক্তিস্বরূপ তারা নাটোর জেলার বড়াইগ্রাম থানার ধানাইদহ গ্রামের চতুর্থ ও পঞ্চম শতাব্দীর গুপ্ত রাজা কুমার গুপ্তের তা¤্রশাসন প্রাপ্তির কথা বলেন। এই তা¤্রশাসন পাওয়ার পর প-িতবর্গ আরও জোড়ালো যুক্তি প্রদর্শন করেছেন। তারা মনে করেন, চলনবিলের দক্ষিণ অংশ বিশেষ করে বড়াইগ্রাম ও চাটমোহর থানা অনেক পূর্ব থেকেই বাসোপযোগী ছিল। অপরদিকে রায়গঞ্জ, উল্লাপাড়া এবং তাড়াশ থানার উত্তর প্রান্তে সেন রাজত্বকালে বেশকিছু গ্রাম প্রতিষ্ঠিত হয়। সিরাজগঞ্জ জেলার তাড়াশ থানার অন্তর্গত মাধাইনগর গ্রামে সেন বংশীয় রাজা লক্ষণ সেনের একখানি তাম্রশাসন পাওয়া গেছে। বরেন্দ্রভূমির সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নতাত্ত্বিক সম্পদের অন্যতম পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার। প্রতœতাত্ত্বিক গুরুত্বের দিক দিয়ে এটি বৌদ্ধ ও হিন্দু সংস্কৃতির এক অপূর্ব সংমিশ্রণ। জয়পুরহাট ও নওগাঁ জেলাসদরের সাথে সড়ক যোগাযোগ সংযুক্ত আছে বিহারটি। মহাস্তানগড় থেকে এর দূরত্ব ঊণত্রিশ কিলোমিটার।
৫. সুন্দরবনের বিভাজন: তত্ত্ব-তালাশ
সুন্দরবন বিভাজনের উৎস অনুসন্ধান করতে গেলে এতদঞ্চলে মানুষের বসতি, সমাজ, ধর্ম-সংস্কৃতি, সম্প্রদায়, সভ্যতা, ভাষা, শিল্প-সাহিত্য-দর্শন, খাদ্যাভ্যাস, সংঘ, সংগঠন সকল কিছুই ভৌগোলিক ও ভূ-তাত্ত্বিক পরিবেশের সাথে অভিন্ন বিবেচনায় নিয়ে অগ্রসর হতে হবে। রাজা-মহারাজার যুগে এ দেশে সাধারণ মানুষের মিঠাপানির তৃষ্ণা নিবারণের জন্য অসংখ্য দীঘি এবং পুস্করণী খনন করা হতো, লঙ্গরখানা খোলা হতো। কিন্তু এই দীঘি এবং জলাশয় খননেও ধর্মীয় ছাপ বিদ্যমান। সাধারণভাবে দৃষ্ট হয় হিন্দু প্রধান রাজা-জমিদারদের খনিত দীঘি উত্তর-দক্ষিণ বরাবর অবস্থিত, কখনোই পূর্ব-পশ্চিমে বিস্তৃত নয়। অপর দিকে মুসলিম রাজা-জমিদারদের দীঘি সাধারণত পূর্ব-পশ্চিমে বিস্তৃত। হিন্দু সমাজে বর্ণভেদ প্রথা এত প্রকট ছিল যে, চার বর্ণের বাইরে যারা ছিলেন তাদেরকে অস্পৃশ্য জ্ঞান করা হতো। শাস্ত্রীয় ধর্মগ্রন্থ স্পর্শ করার কোনো বিধান তাদের জন্য ছিল না। সংস্কৃত ভাষা এবং বর্ণমালা শিক্ষার সুযোগও তাদের দেওয়া হয়নি, উপরন্তু ম্লেচ্ছ জ্ঞান করে সমাজ থেকে দূরে রাখা হয়েছে। ব্রাহ্মণদের জন্য স্বতন্ত্র গ্রাম চিহ্নিত করা হয়েছে, সেখানে নিম্নবর্গের মানুষের প্রবেশাধিকার ছিলনা। এমনকি পুকুর বা দীঘির জলস্পর্শ করার অধিকারও তাদের ছিলনা। ভারতের সংবিধান প্রণেতা এম বি আম্বেদকর এবং তার সম্প্রদায়কে এই পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়েছে। দিল্লীতে আইন-প্রণেতা হিসেবে অবস্থানকালীন তার কক্ষ পরিষ্কার করতে অস্বীকৃতি জানায় ঝাড়ুদার। কারণ, তাদের বিবেচনায় তিনি জাতে ম্লেচ্ছ, নমঃশুদ্র। একই পরিস্থিতি মোকাবেলা করে আজও রাজশাহীর গোদাগাড়িতে অভিমানে আত্মহত্যা করতে হয় আদিবসী কৃষক অভিনাথ এবং রবিকে। টাকা দিয়েও ঠিকমতো সেচের জল না পাওয়া, চায়ের দোকানে বসতে না পাওয়া, জলের গেলাশে জলপান করতে না পারা, কিংবা হাতের তালুতে জলপান করা, দাঁড়িয়ে আলাদা কাপে চা পান করা প্রভৃতি সামাজিক অসঙ্গতির কারণে আত্মহত্যা করেন নিম্নবর্গীয় এই দুই আদিবাসী কৃষক। মুসলিম সমাজেও আশরাফ-আতরাফ সমস্যা, শিয়া-সুন্নী বিভেদ চিরকালই ছিল। আভিজাত্যের বড়াই আজও টিকে আছে। সৌদি আরব, ইরান-ইরাক, তুরস্ক, পাকিস্তান, সিরিয়ার মতো দেশে শিয়া-সুন্নী দ্বন্দ্ব, যুদ্ধ-বিগ্রহ চিরকালীন। কাদিয়ানী বা আহমদিয়াদের অমুসলিম ঘোষণা করার দাবি বাংলাদেশে বর্তমান। তাদেরকে সকলে মুসলিম বলে স্বীকারও করেন না। বাংলাদেশে আজও জোলা-গৃহস্থ চাপান-উতোর চলমান। যেখানে হিন্দু মুসলিম নেই, সেখানে দ্বন্দ্ব জিঁইয়ে রাখতে যে কোনো একটি মতভেদ বা বৈষম্যকে সামনে নিয়ে রাজনৈতিক স্বার্থে দাঙ্গা বাঁধানোই যেন মানুষের প্রবৃত্তি।
ইংল্যান্ডে ভারত-পাকিস্তান-বাংলাদেশের মানুষকে শুনতে হয়, ‘পাকি বাস্টার্ড’ গালি। বর্ণভেদের কারণে রেস্টুরেন্টে বসতে না পাওয়া বিশ্বচ্যাম্পিয়ন মুষ্টিযোদ্ধা ক্যাসিয়াস ক্লে টেমস্ নদীতে পদক ফেলে দিয়ে হয়ে যান, মোহাম্মদ আলী। আমেরিকায় সাদা চামড়ার পুলিশের হাতে নিগৃহীত হয়ে মৃত্যুর মুখে পতিত হন কৃষ্ণাঙ্গ যুবক। ফিলিস্তিনের মুসলমানদের নিজ ভূমি থেকে বাস্তুচ্যুত করা কিংবা রোহিঙ্গাদের দেশ ছাড়া করার সামরিক শক্তি প্রয়োগের দৃষ্টান্ত আজ চোখের সামনেই ঘটছে। বাংলাভাষী হওয়ার কারণে সংস্কৃত ব্রাহ্মণ কিংবা আরবি-ফারসি ব্রাহ্মণদের হাতে প্রাকৃতজনদের নিগৃহীত হওয়ার অজ¯্র দৃষ্টান্ত ছড়িয়ে রয়েছে ইতিহাসে। আজও জাতিগত বিদ্বেষ উসকে দিতে বাংলাভাষীদের নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়াার মতো ঘটনা ঘটছে কোনো কোনো দেশে। মার্কিন-ব্রিটিশ-ইউরোপীয় ব্রাহ্মণদের আধিপত্য বজায় রেখে প্রাকৃতিক সম্পদের দখল এবং অস্ত্রের বাণিজ্যকে সুনিশ্চিত করতে যুদ্ধ বাঁধানো হয়; ধ্বংস হয় গাজা উপত্যকা, রামাল্লার ঘরে ঘরে আগুন জ্বলে, ধ্বংস হয় ইরাক, লেবানন, সিরিয়া, আফগানিস্তান। আধিপত্য বিস্তারের প্রতিযোগিতায় ধ্বংস হয় ইউক্রেন, মৃত্যু হয় সাধারণ মানুষের। বিভাজন এবং আধিপত্য এখন ব্যক্তি কিংবা সমাজের মধ্যে সীমায়িত নেই, আন্তর্জাতিক পরিম-লে বৈশ্বিক আধিপত্যবাদের প্রতিযোগিতা চলছে। বহুজাতিক গোষ্ঠীর স্বার্থকে সামনে রেখে সুন্দরবনের সীমানায় চাপিয়ে দেওয়া হয় বড়ো বড়ো প্রকল্প; উৎখাত হয় মানুষ, হারিয়ে যাওয়ার পথে জীববৈচিত্র্য, হারিয়ে যায় ইরাবতী ডলফিন, রয়েল বেঙ্গল টাইগার হারায় তার নিরাপদ আশ্রয়। ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদের সাথে সাথে বৃক্ষকুল চিরতরে নিশ্চিহ্ন হওয়ার পথে। সুন্দরবনের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত সচেতন মানুষ। বর্ণবাদ এবং বিভেদ দেশে-দেশে, ধর্মে-ধর্মে, জাতিতে-জাতিতে, ভাষায় ভাষায়। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার বিষবাষ্প এখন তেজস্ক্রিয়তার মতো ভয়ানক রূপে ছড়িয়ে পড়েছে সবদিকে।
অঞ্চল, জাত-ধর্ম-সম্প্রদায় ভিত্তিক আচার-প্রথা-রেওয়াজ, খাদ্যাভ্যাস প্রভৃতির পার্থক্য চিরকালই ছিল, আজও আছে। দেশভাগ পূর্ব ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠী কর্তৃক হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে বৈষম্যের সৃষ্টি, উভয় সম্প্রদায়ের মাঝে সৃষ্ট ধর্মীয় কায়েমী স্বার্থের প্রভাব, ব্রিটিশদের চক্রান্ত, মুসলমানদের ব্রিটিশ বিরোধী মনোভাব, চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রবর্তন, ব্রিটিশ-হিন্দু সখ্য, ব্রিটিশ শাসকদের ভারতের স্বার্থবিরোধী বিভিন্ন বৈষম্যমূলক নীতি প্রণয়ন, ব্র্রিটিশ সরকারের মুসলমানদের প্রতি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি, ধর্মভিত্তিক সংগঠনের বিকাশ, ধর্মীয় জাতীয়তাবোধের বিকাশ, ধর্মবেত্তা ও সমাজসংস্কারকদের একগুয়ে মনোভাব, হিন্দু-মুসলমানের পারস্পরিক অসহিষ্ণুতা, কংগ্রেস প্রতিষ্ঠা, বঙ্গভঙ্গ, মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠা, বঙ্গবঙ্গ রদ, ভারত বিভক্তি প্রভৃতি ঘটনা উপমহাদেশে সাম্প্রদায়িক সংঘাত বিভাজনের সৃষ্টি করেছে। বিভক্ত হয়েছে ভারত, বিভক্ত হয়েছে বাংলা; বিভক্ত হয়েছে সুন্দরবন। পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন সভ্যতাগুলির একটির উৎপত্তি ঘটে ভারতে। এখানেই গড়ে উঠে অত্যন্ত উঁচুস্তরের উন্নত এক সংস্কৃতি; যা এই দেশের পরবর্তী বিকাশের ক্ষেত্রে এবং সমগ্রভাবে গোটা প্রাচ্যের, মধ্য ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ও দূর প্রাচ্যের বহু জাতির সংস্কৃতিতে বিপুল প্রভাব বিস্তার করে। বাংলাদেশের সুন্দরবন অঞ্চলের সংস্কৃতিতেও এই ভারতীয় অভিন্ন সভ্যতার প্রভাব পড়েছে অনিবার্যভাবে। ভারতীয় প্রত্নপ্রস্তরযুগ, মধ্য ও নব্যপ্রস্তরযুগ, সিন্ধুপ্রেেদশের হরপ্পা-মহেঞ্জোদারো সভ্যতা, মধ্য-পশ্চিম ও পূর্ব-ভারতের তা¤্র-প্রস্তরযুগীয় সংস্কৃতি, ইন্দো-আর্য গোষ্ঠী প্রভৃতির প্রভাবপুষ্ট এই আমাদের গঙ্গা-উপত্যকা বাংলাদেশের সভ্যতা। হরপ্পা এবং মহেঞ্জোদারোর মতো সভ্যতা আবিষ্কারের পূর্বে এমন ধারণা ছিল যেন আর্যরাই এদেশে এসে সভ্যতার সূচনা করে এং তার পূর্বে বঙ্গ-ভারতীয়রা যেন ছিল বর্বর। এমনকি আর্যদের আদি বাসভূমি কোথায় এ বিষয়টিও একসময় বিতর্কিত বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত ছিল। কোনো কোনো প-িত আর্যদের ভারতে অনুপ্রবেশকে দেখেছেন অতি উন্নত আর্যদের দ্বারা পশ্চাৎপদ আদিবাসীদের পদানত করা হিসেবে। প্রাচীন ইন্দো-আর্যদের লিখিত পুথি যা এ পর্যন্ত পাওয়া গেছে তা থেকে প্রত্নতত্ত্ববিদগণ ধারণা করেন যে আর্যরা পূর্ব পাঞ্জাবে এবং যমুনা ও গঙ্গা নদীর ধারাদুটির উত্তরাংশ-বরাবর বসতি স্থাপন করেছিলেন। আদিতম ইন্দো-আর্যদের আকর সাহিত্য হলো ঋগ্বেদ। বেশির ভাগ আধুনিক বিশেষজ্ঞই এই আদি বেদ খ্রীষ্টপূর্ব এগারো কি দশ শতকে লিখিত বলে নির্দেশ করেছেন। বৈদিক সাহিত্যের পরবর্তী পুথিগুলি - অর্থাৎ পরবর্তী সংহিতা, অরণ্যক ও ব্রাহ্মণসমূহ লিখিত হয় খ্রীষ্টপূর্ব আট থেকে ছয় শতকের মধ্যে। কৃষিকাজ ও পশুপালন ছিল বৈদিক আর্য উপজাতিদের জীবনে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি জীবিকা। বেদগ্রন্থগুলিতে বারে বারে এ কথার উল্লেখ রয়েছে যে গৃহপালিত পশুপালের মধ্যেই নিহিত মানুষের সকল ঐশ্বর্যের প্রধান উৎস। বৈদিক সুক্তগুলির রচয়িতারা বারে-বারে দেবতাদের সমীপে এই প্রার্থনাই জানাচ্ছেন যে মানুষের ওপর অজস্র গোধন দানের করুণা বর্ষণ করা হোক; আরও অধিকসংখ্যক গোধন সংগ্রহের একটা উপায় যে যুদ্ধ-বিগ্রহে লিপ্ত হওয়া তা-ও বলেছেন তাঁরা। বৈদিক আর্য উপজাতিগুলির নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ-বিগ্রহের প্রধান কারণই ছিল এই পরস্পরের গৃহপালিত পশুহরণ।
ঐ সময়ে গৃহপালিত প্রাণিকুল ও মাঠের ফসল নানা বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা করতে বিশেষ ধরনের যাগযজ্ঞের অনুষ্ঠান করা হতো। ঐ যুগে যানবাহন বলতে ছিল বলদে-টানা গাড়ি ও ঘোড়ায়-টানা রথ। বৈদিক আর্য উপজাতিগুলি বাস করতো ছোটো ছোটো প্রাকারবেষ্টিত জনবসতিতে। প্রত্নতাত্ত্বিক খননকার্যের ফলে যা জানা সম্ভব হয়েছে তা থেকে অনুমান করা যায় যে আবাসের এই ‘পুর’গুলি তৈরি হতো কাঠ কিংবা খড়মেশানো কাদা-মাটি দিয়ে গড়া ছোটো ছোটো বসতবাড়ি ও কালেভদ্রে পাথরের তৈরি বাড়ি দিয়ে, আর মাটির তৈরি প্রাকার দিয়ে ঘেরা থাকতো শহরগুলি। কৌশাম্বীতে ভারতীয় প্রতœতত্ত্ববিদদের খননকার্যের ফলে যা জানা গেছে তা থেকে মনে হয় যে হরপ্পা-যুগের গৃহনির্মাণ-শিল্পের কৃৎকৌশল, ইত্যাদির কিছু কিছু পূর্ব ভারতের বৈদিক আর্য উপজাতিদের জানা থাকা সম্ভব, তবে ঐ কৃতকৌশল এই শেষোক্ত উপজাতিদের গৃহনির্মাণশিল্পের ওপর নির্ধারক প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি। প্রত্নতাত্ত্বিক খননকার্যের ফলে আরও জানা গেছে যে গঙ্গা-উপত্যকার নগরকেন্দ্রগুলি গড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে সেখানে নানাবিধ কারুশিল্পেরও অগ্রগতি ঘটেছিল। বেদান্তগ্রন্থগুলিতেও নানাবিধ কারুশিল্পীর উল্লেখ পাওয়া যায়, যেমন, কামার, কুমোর, ছুতোর, মণিকার, অস্ত্র-নির্মাতা ইত্যাদি। এঁদের মধ্যে সবচেয়ে সম্মানজনক পেশা ছিল ছুতোর এবং কামারের, কারণ তারা চাষের যন্ত্রপাতি ও অস্ত্রশস্ত্র বানাতেন এবং বাড়ি তৈরি করতেন। ব্যবসা-বাণিজ্য ঐ সময়ে কেবল যে বিভিন্ন উপজাতি ও তাদের নগর-জনপদের মধ্যেই গড়ে উঠেছিল তা-ই নয়, বিদেশের সঙ্গেও গড়ে উঠেছিল বাণিজ্য। সম্ভবত সমুদ্রপথেই গড়ে উঠেছিল তা। বৈদিক সুক্তগুলিতে এক শো-দাঁড়ওয়ালা সমুদ্রগামী জাহাজের উল্লেখ আছে, আর উল্লেখ আছে সমুদ্রে নিহিত অতুল ঐশ্বর্যের। নদীপথে যাতায়াতের জন্যও তখন বড়ো-বড়ো নৌকোর চলন থাকা সম্ভব। ক্রমশ এইসব নগর-বসতিতে দেখা দেয় পেশাদার ব্যবসায়ীদের বিশিষ্ট একটি গোষ্ঠী। প্রচুর গৃহপালিত পশুর মালিক ধনী উচ্চ সম্প্রদায়ের পাশাপাশি দেখা দিয়েছিল অত্যন্ত দরিদ্র জনসমষ্টির স্তরগুলি। বেদান্তগ্রন্থগুলিতেও থেকে-থেকে ধনী এবং দরিদ্র মানুষের উল্লেখ পাওয়া যায়, দেখা যায় ধনীরা বলিদানের জন্য চমৎকার সব প্রাণী উৎসর্গ করছেন আর মুক্তহস্তে দান করছেন পূজোর নানাবিধ উপচার-উপহারাদি, অন্যপক্ষে সাধারণ গ্রামবাসীরা দিচ্ছেন দীন নানা উপচার। ঋব্দেদে গবাদি পশুর গায়ে ছাপ দেয়ার উল্লেখ আছে, স্পষ্টতই বোঝা যায় কোন গৃহপালিত পশু কার মালিকানাধীন এটা বোঝানোর জন্যই এই ছাপ দেয়ার ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল।
বৈদিক রচনায় (বিশেষত অপেক্ষাকৃত পরবর্তী বৈদিকযুগের রচনাগুলিতে) ভূমিদান ও ভূমিক্রয় সম্বন্ধে বিস্তৃত বিরণাদি পাওয়া যায়, যদিও তখন সম্পত্তির অধিকার ছিল বহুপরিমাণে ‘গোষ্ঠীর ইচ্ছা’ সাপেক্ষ। চাষের অধীন ভূ-খ- উপজাতি-গোষ্ঠীর ব্যক্তিগত সদস্যদের মধ্যে বিলি করা হতো তখন আর এর ফলে সম্পত্তির অধিকার ও সামাজিক পদমর্যাদার পার্থক্যের ভিত্তিতে সামাজিক অসাম্য আরও বৃদ্ধি পাওয়ার পথ সুগম হয়ে উঠেছিল। পেশা, বৃত্তি তথা জীবিকার আবর্তে প্রতিটি মানুষই একটি সমাজের মূল্যবোধ, নৈতিকতা, সামাজিক ভূমিকার সমন্বয়ে সমাজ কাঠামোর অংশ হয়ে উঠে। প্রতিটি সমাজের কাঠামোই ঐতিহাসিক নানাবিধ শর্তযুক্ত উপাদানে বিন্যস্ত। একটু পেছনে গেলে দেখা যায় যে, প্রাক ব্রিটিশ যুগে বাংলা তথা ভারতবর্ষের আর্থ-রাজনৈতিক কর্মপন্থা পশ্চিম ইউরোপের সামন্তযুগের ব্যবস্থার মতো ছিলনা। ইউরোপীয় সামন্তবাদের মধ্যে ভূমিমালিক বনাম ভূমিদাসদের মধ্যে ক্রমোচ্চ শ্রেণিবিভাগজনিত সম্পর্ক, ভূমির ওপর অধিকার, ব্যক্তিগত সামরিক বাহিনি গড়ে তোলা ইত্যাদি প্রধানতম শর্ত হিসেবেই বিদ্যমান ছিল। বাংলা তথা ভারতবর্ষের সামন্ত যুগের ইতিহাসে কিন্তু এমন লক্ষ করা যায় না। ভারতবর্ষে নাগরিক সমাজ গড়ে না ওঠার পেছনে বর্ণভেদ প্রথা, অন্তর্বিবাহ প্রথা এবং নবগঠিত নগরকেন্দ্র ধ্বংসের মতো পদক্ষেপ গ্রহণের মতো নানাবিধ বিষয়ের সাথে সামাজিক-সাংস্কৃতিক কারণে ইউরোপের মতো নাগরিক সমাজ সামন্ত যুগে বিকাশ লাভ করেনি। যদিও ব্রিটিশ বা মুসলিম শাসনের পূর্বেই একটি ধনিক শ্রেণি ভারতে ছিল, কিন্তু তাদের দ্বারা ইউরোপীয় সমাজের ন্যায় কোনো মধ্যবিত্ত শ্রেণি বা বুর্জোয়া শ্রেণি গড়ে উঠেনি। মধ্যযুগীয় বাংলায় অতিরিক্ত মুনাফা লোভী তথা মহাজনী পুঁজিবাদের একটা উদ্ভব ছিল সমাজ কাঠামোর গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ। মূলত, ধনী হিন্দু কৃষক ও বণিক সম্প্রদায়ের একচেটিয়া অধিকারে ছিল মহাজনী বৃত্তি। ইসলামী দর্শনে সুদগ্রহণে নিরুৎসাহিত করার কারণে প্রাক-ব্রিটিশ ও বৃটিশ শাসনামলে বাংলায় মুসলিম পুঁজিপতি বা মহাজনদের প্রাধান্য খুব বেশি দেখা যায় না। বঙ্গ-ভারতীয় বণিক শ্রেণি ইউরোপের সমাজের ন্যায় সামন্ত শাসক বিরোধী কোনো শক্তি গড়ে না তোলায় এখানে সমাজ কাঠামো ইউরোপের ন্যায় রূপলাভ করেনি। এ সকল পুঁজিপতিরা সামন্ত প্রভুদের কাছ থেকে খাজনা পরিশোধের বিনিময়ে জমিদারি বা তালুকের অধিকার লাভ করলেও মালিকানা লাভ করেনি। ফলে, ব্রিটিশের আগমনের পূর্ব পর্যন্ত বাংলায় জমিদারি স্বত্ব লাভের কোনো দৃষ্টান্ত দেখা যায় না। তার পূর্বে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে নির্ধারিত পরিমাণ অর্থ জমাদান করাই ছিল জমিদারি রক্ষা করার পূর্ব শর্ত। লর্ড কর্নওয়ালিসের ১৭৯৩ সালের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ভূমিস্বত্ব আইন প্রয়োগের মাধ্যমে বাংলার ক্ষুদ্র মুসলমান অভিজাত শ্রেণির ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে। পুঁজিপতি হিন্দু বণিক ও মহাজন গোষ্ঠীর মধ্যে থেকে উদ্ভব হয় নতুন জমিদার গোষ্ঠীর। এই নতুন কাঠামোর বাংলার অধিকাংশ জমির মালিকানা উচ্চবর্ণের হিন্দু স্প্রদায়ের হস্তগত হয়। জমিদারদের অধীনে থাকে পত্তনিধারী জোতদার, গণপতিদার, তালুকদার ও ভূঁইয়াদের মতো মধ্যবর্তী খাজনা আদায়কারী গোষ্ঠী। ঊনিশ শতকেও বিত্তবান হিন্দু শ্রেণিভুক্ত সর্বোচ্চ বর্ণ হিন্দু ব্রাহ্মণ, কায়স্থ এবং বৈশ্যগণের অর্ধেক ছিল প্রজাদের পরিশোধিত খাজনা দ্বারা পরিচালিত জমিদার শ্রেণি; এক চতুর্থাংশ ছিল আইনজীবী, চিকিৎসক ও পুরোহিত শ্রেণির মতো পেশাজীবীগণ, বাকিরা ছিল অফিস-আদালত, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বা জমিদারের কর্মচারী শ্রেণি। এই শ্রেণি থেকে শিক্ষা ও বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চায় রাজনৈতিক সচেতন একটি শ্রেণি বেরিয়ে আসে যারা হিন্দু সমাজকে নেতৃত্ব প্রদান করে। মুসলমান সমাজে আধুনিক বিকাশমান ব্রিটিশ প্রবর্তিত শিক্ষা থেকে দূরে থাকার কারণে মধ্যবিত্ত এবং রাজনৈতিক সচেতন একটি শ্রেণি গড়ে উঠতে বিলম্ব হয়। বিশেষ করে ওয়াহাবী মতাদর্শে উদ্বুদ্ধ সচেতন মুসলিম শ্রেণি যতটা নিজ সমাজকে শিক্ষা-সংস্কৃতি, রাজনৈতিক জ্ঞানে প্রাগ্রসর করে গড়ে তোলা যায় সেদিকে মনোযোগী না হয়ে; ইসলামের বিশুদ্ধবাদী শরীয়ত চর্চাকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে সমাজ সংস্কারের জাগতিক অবস্থান থেকে পিছিয়ে পড়ে। ফলে, কিছুসংখ্যক মুসলিম উচ্চশিক্ষা লাভ করলেও মুসলিম সমাজের সংখ্যার তুলনায় তা অতি অল্প। এভাবে, বিদ্যমান বৈষম্যের ফলে মুসলিম সমাজে দারিদ্র্য দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এবং ভিক্ষাবৃত্তি জীবিকার একটি অনিবার্য মাধ্যম হয়ে ওঠে। যদিও বিশেষ কোনো পরিসংখ্যান নেই, তবুও তৎকালীন সমাজ কাঠামোর বিশ্লেষণ থেকে ধারণা করা যায় ভিক্ষবৃত্তি প্রাক-বৃটিশ শাসন ব্যবস্থার পর্ব থেকে বৃটিশ শাসনামলে মুসলিম সমাজে অনেক বেড়ে যায়।
৬. ৬. সুন্দরবন ও বাঙালি সংস্কৃতির বৃত্তবলয়
সুন্দরবন অঞ্চলের সাংস্কৃতিক উপাদানের মধ্যে পটের গান, বনবিবির পালা, ধনা দুখের পালা, সারিগীত ও ভাটিয়ালী, গুরুবাদী সংগীত, বারাসিয়া, অষ্টক গান, চড়কের গান, গাজির গান, মানিক পিরের গান, লৌকিক দেবদেবীর গান, দক্ষিণা রায়ের গীত, নারায়নী, ওলা বিবি, হাড়ির ঝির গান এবং সুন্দরবন রক্ষার গান ও নাটক উল্লেখযোগ্য। সবকিছুকে ছাপিয়ে পটের গান এবং গাজি-কালু- চম্পাবতীর গান এ অঞ্চলে অধিক জনপ্রিয় ও পরিচিত। এ দু‘টি বিষয় নিয়ে আলোচনার পূর্বে সুন্দরবন অঞ্চলের মানুষের কৃষি, জীবন-জীবিকা, ভৌগোলিক পরিবেশ ও সংস্কৃতির সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করা জরুরী; যা সমগ্র বাংলার অভিন্ন সংস্কৃতির পাটাতনে অমূল্য সম্পদ হিসেবে পরিগণিত।
৬.১ কৃষি ও জীবিকাকেন্দ্রিক সংস্কৃতি
প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে সুন্দরবনসহ সমগ্র বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের ভূ-প্রকৃতি, পরিবেশ, নদী প্রভৃতি এতদঞ্চলের মানবগোষ্ঠীর কৃষি, খাদ্যাভ্যাস, লোকাচার, জীবন-জীবিকার ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলে চলেছে; যা এ অঞ্চলের বৃহত্তর এবং অবিচ্ছেদ্য সংস্কৃতিরই অংশ। বর্তমান উপশিরোনামে আলোচনায় আমরা উপমহাদেশের পরিবেশ ও ভূ-প্রকৃতিগত কনটেক্সট, টেক্সট এবং কনটেক্সচুয়াল উপাদানগত বিশ্লেষণের বিষয়টি গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করবো। গবেষক ও নৃবিজ্ঞানীগণ ধারণা করেন যে বাংলার বেশ কিছু আদি ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর দেহ বৈশিষ্ট্যে প্রটো-অষ্ট্রালয়েড (Proto Australoid) উপ নরগোষ্ঠীর চিহ্ন বা নিদর্শন বেশ স্পষ্ট। ব্রিটিশ শাসিত বৃহত্তর বাংলার অবিচ্ছেদ্য অংশ সুন্দরবনসহ দক্ষিণ ভারত, শ্রীলংকা, মালয়েশিয়া পপুয়া নিউগিনি সর্বোপরি অষ্ট্রেলিয়ার মূল ভূখ-ে সুদুর অতীত কাল থেকে বসবাস করছে অষ্ট্রোলয়েড ও প্রটো-অষ্ট্রোলয়েড নরগোষ্ঠীর মানুষ। অষ্ট্রেলিয়ার আদি জনগোষ্ঠী থেকেই অষ্ট্রোলয়েড নামের উৎপত্তি। প্রটো-অষ্ট্রোলয়েড উপ-নরগোষ্ঠীর দেহ দৈর্ঘ মাঝারি থেকে খর্বাকৃতির। এদের মাথার খুলি মাঝারি থেকে সামান্য লম্বাটে, গাত্রবর্ণ ঘনকালো, নাসামূল অবনমিত ও নাসাপ্রান্ত প্রশস্ত, মাথার চুল কোঁকড়ানো। বাংলাদেশের সুন্দরবন, উত্তরাঞ্চলের করতোয়া, আত্রাই, পূণর্ভবা বিধৌত বরেন্দ্র অঞ্চলে বসবাসকারী প্রাচীন জনগোষ্ঠী পুন্ড্র, পুঁড়া বা পোদ নামে অভিহিত। এদের দেহ বৈশিষ্ট্যের সাথে প্রটো-অষ্ট্রোলয়েড উপ-নরগোষ্ঠীর খুব ঘনিষ্ট সাদৃশ বিদ্যমান। প্রাচীন পুন্ড্র জনগোষ্ঠীর মানুষ ছিলেন অষ্ট্রিক ভাষাভাষী। এরা এদেশে এসে প্রথমে যাযাবর জীবন ত্যাগ করে এক স্থিতিশীল সমাজ জীবনের সূচনা করে। এরাই বাংলাদেশে প্রথম কৃষির প্রচলন ঘটায়। প্রথম পর্যায়ে উদ্যান কৃষি (লাউ, কুমড়া, কচু, হলুদ, পান ইত্যাদি) এবং ক্রমান্বয়ে নিবিড় কৃষির (ধান, কলাই, ইক্ষু ইত্যাদি) প্রসার ঘটায়। এরা বাংলাদেশে সর্বপ্রথম লাঙলের ব্যবহার শুরু করেছিল। ধান, লাউ, কুমড়া, কলা বেগুন, পান, লাঙল, সুপারি, পানের বরজ, ঢেঁকি এইশব্দ গুলো অষ্ট্রিক ভাষার অন্তর্ভুক্ত ((Meloney: 1984, Grierson: 1906)।
প্রাচীনকাল থেকেই কৃষি বাঙালির জীবিকার উৎস। সুন্দরবনসহ উপমহাদেশের অন্যান্য অংশের অবস্থাও প্রায় অভিন্ন। কিন্তু প্রায় গোটা বাংলা পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাতসহ তিনটি প্রধান নদী পদ্মা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা এবং তাদের অসংখ্য শাখা প্রশাখা প্রসারিত পলিগঠিত সমভূমি হওয়ার দরুন প্রাচীনকাল থেকেই এখানে কৃষিকাজ অপেক্ষাকৃত সহজ ছিল এবং এখানে কৃষির ওপর জনসংখ্যার চাপ ছিল অত্যধিক। প্রাচীন, মধ্যযুগ ও ব্রিটিশ আমলে কৃষি অর্থনীতির সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য ছিল উপখাত হিসেবে শস্য-উৎপাদনের অত্যধিক প্রাধান্য। কৃষির অন্য তিনটি উপখাত পশুসম্পদ, মৎস্য ও বন ছিল অপেক্ষাকৃত গুরুত্বহীন। বিভিন্ন ধরনের ফসল আবাদ করা হতো এবং সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় সংগ্রহের সময় অনুযায়ী এগুলি তিন শিরোনামে উল্লেখ করা হতো; ভাদই (শারদ), খারিফ (হৈমন্তী) ও রবি (বাসন্তী)। এসব ফসলের মধ্যে ছিল ধান, পাট, গম, জোয়ার, যব, আখ, তামাক, তৈলবীজ, আলু, পেঁয়াজ, রসুন, আফিম, নীল, চা, বিভিন্ন ধরনের শাকসবজি, ডাল, সুগন্ধি ও মসলা। ধান ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও প্রাচীনতম শস্যগুলির একটি। মহাস্থান ব্রাহ্মী শিলালিপিতে খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় বা দ্বিতীয় শতকে ধানের সর্বপ্রথম উল্লেখ পাওয়া যায়। অন্য কয়েকটি লেখায়ও এ শস্যের উল্লেখ রয়েছে, কালিদাসের ‘রঘুবংশ’ ও ‘রামচরিত’ গ্রন্থে এবং ‘কাসাপালা’ ও ‘সদুক্তিকর্ণমৃত’ প্রভৃতি রচনায়। সেন রাজত্বে বিশেষভাবে বিভিন্ন লিপিতে ধানক্ষেতের বিস্তর বর্ণনা পাওয়া যায়। লক্ষ্মণ সেনের আনুলিয়া তা¤্রশাসনে হেমন্তে শালিধান কাটার উল্লেখ রয়েছে। একই লিপিতে আরও আছে যে, রাজা ব্রাহ্মণদের ধানীজমিসহ কয়েকটি গ্রাম দান করেন। ইদিলপুর তা¤্রশাসনে ধানের আরেকটি উল্লেখ পাওয়া যায়। এতে ধানকে সাধারণ অর্থে শালি বলা হয়েছে। আসলে, বাংলার বিভিন্ন সুপ্রাচীন জনপদ বঙ্গ, বরেন্দ্র, গৌড়, পুণ্ড্রবর্ধন, হরিকেল, রাঢ় ও সমতটে উৎপন্ন অনেকগুলি জাতের মধ্যে এটি সর্বোত্তম। বরিশাল কিংবা প্রাচীন চন্দ্রদ্বীপ, বাকলা নতুবা বাকরগঞ্জ কিংবা সাতক্ষীরা অঞ্চলের বালাম চাল অতীতকাল থেকেই বিশ^বিখ্যাত। বরিশালকে বাংলার শস্যভাণ্ডার নামেও অভিহিত করা হয়ে থাকে।
সুদূর অতীত কাল থেকেই এদেশের মানুষের উৎপাদিত প্রধান শস্য ধান। গঙ্গা-ব্রক্ষ্মপুত্র-করতোয়া-তিস্তা-যমুনা-মেঘনা-ভৈরব-কালিন্দি-কর্ণফুলি বিধৌত বিশাল অববাহিকায় বসবাসকারী জনগোষ্ঠীর খাদ্যাভ্যাস ধানকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। ধান থেকে নানা ধরনের খাদ্য সামগ্রী তৈরির ঐতিহ্য অনেক পুরাতন। বাংলাদেশের মানুষ এখন অবধি ধান সংস্কৃতির এই পরম্পরা ধারণ করে চলেছে। এদেশের দিগন্ত বিস্তৃত মাঠে যখন ধান পেকে সোনালি রূপ ধারণ করে আর রৌদ্রের কিরণে তা হয়ে উঠে আরও উজ্জল, তখন থেকেই কৃষকের কুটির আনন্দ উচ্ছ্বাসে প্লাবিত হতে থাকে। নতুন ফসল শুধু আমাদের কৃষি জীবনের আনন্দ ধ্বনি নয়, এটি সমগ্র বিশে^র কৃষকদের অন্তরে একই সুরে একই লয়ে অনুরণিত হতে থাকে। বাংলার সামাজিক জীবনে নতুন ফসল হলো আনন্দ উৎসবের প্রধান উপাত্ত ও অবলম্বন। নতুন ফসল ঘরে আসা মানে পিঠা-পুলি-পায়েসের আয়োজন। হৈমন্তী ধান মাঠ থেকে কেটে আঙ্গিনায় আনা এরপর ধান মাড়াই, ধান সেদ্ধ, ধান ভানা পিঠা-পুলি পায়েসের আয়োজন এগুলো সামগ্রিকভাবে সুন্দরবন অঞ্চলসহ আবহমান বাংলার সামাজিক সংস্কৃতি ও সাহিত্যাঙ্গনে নবান্ন নামে অভিহিত। এই সংস্কৃতি বাংলার এক গৌরবময় ঐতিহ্য। বিশাল গঙ্গা-ব্রক্ষ্মপুত্র-কপোক্ষ-হুগলী-মাতলা-স্বরমঙ্গলা অববাহিকায় বসবাসকারী নানা গোত্র-বর্ণ ও ধর্মের মানুষদের কৃষিভিত্তিক যে সামাজিক জীবন তার সঙ্গে মিলে মিশে রয়েছে নানা পার্বণ। এর মধ্যে নবাণ্ন আর পৌষ পার্বণ সব থেকে জনপ্রিয়। ধানকেন্দ্রিক লোকাচার-উৎসব-পার্বণ বাঙালির চিরন্তন সংস্কৃতিরই অঙ্গ, যা সুন্দরবনকেন্দ্রিক কৃষিজীবী সমাজে আজও স্বমহিমায় উপস্থিত। এ অঞ্চলের কৃষিভিত্তিক জীবন নানা পালা-পার্বণে মুখরিত থাকে বছর জুড়েই। তবে শরৎ- হেমন্ত-শীত এবং বসন্তকালেই থাকে নানা পালা পার্বণের আয়োজন। গ্রীষ্মকালেই বাংলার মধুমাস। গ্রীষ্মের দুই থেকে তিন মাস সারা সুন্দরবন অঞ্চলের মানুষ তরমুজ, লিচু, আম, জাম, কাঠাল, পেয়ারা, কুল, লটকন, আনারস, কমলা ইত্যাদি অসংখ্য মধুমাখা রসালো ফলের আস্বাদে থাকেন অনেকটাই বিভোর। বাঙালীর কৃষিভিত্তিক এক বিশাল লোকসংস্কৃতি সুন্দরবন জনপদের মানুষের আচারের মধ্য দিয়ে লালিত হয়েছে। বছরের বিভিন্ন সময়ে পালা-পার্বণের এক পর্যায়ে নানা ধরনের লোকমেলার আয়োজনের মধ্য দিয়ে চুড়ান্ত ভাবে প্রকাশ পায় পার্বণজনিত আনন্দ উচ্ছ্বাস। এদেশের প্রধান দুটি ধর্মীয় সম্প্রদায় হিন্দু ও মুসলমান। সাধারণত এই দুটি সম্প্রদায়ের ধর্মীয় ও স্ব স্ব সমাজের আচার অনুষ্ঠানের অনেক কিছুই সরাসরি প্রভাব ফেলে কৃষি ভিত্তিক এই পালা-পার্বণে। এছাড়াও এদেশে বসবাসরত বৌদ্ধ এবং খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীরাও তাঁদের নিজস্ব ধর্মীয় অনুষ্ঠানের অংশ হিসেবে নানা ধরনের সামাজিক উৎসব পালন করে থাকেন, যার মূলে রয়েছে কৃষি।
৬.২ পার্বণ ও উৎসবাদি
সুন্দরবনসহ সমগ্র বাংলাদেশের সকল ধর্মীয় সম্প্রদায়ের লোকেরাই বৈশাখী উৎসব এবং নবাণœ উৎসব সম্মিলিতভাবে পালন করে থাকেন। এটি বাংলাদেশের নিজস্ব ঐতিহ্য। বাংলাদেশের পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠান কোনো ধর্মীয় ভিত্তিতে পালিত হয় না। বরং একশত ভাগ অসাম্প্রদায়িক চেতনার ভিত্তিতে এদেশের অন্যতম বৃহৎ এই উৎসবটি পালিত হয়ে আসছে। যদিও ভারতের পশ্চিম বাংলায় একদিন পরে পহেলা বৈশাখের আয়োজন হয়। সেখানে এই অনুষ্ঠানে ধর্মীয় আচার আচরণের ছোঁয়া লক্ষ্য করা যায়। বাংলাদেশে নবান্ন উৎসব সকল ধর্মীয় সম্প্রদায় সম্মিলিতভাবে পালন করে থাকেন। বাংলাদেশসহ ভারতের পশ্চিম বাংলায় মুসলমান সম্প্রদায়ের লোকেরা দুইটি বৃহৎ ধর্মীয় উৎসব ঈদ উল ফিৎর ও ঈদ উল আযহা পালন করেন। এ উপলক্ষে উভয় দেশের শত শত স্থানে ছোট বড়ো মেলা বসে। সমগ্র বাংলার এক বৃহৎ জনগোষ্ঠী (শতকরা ৬৫ জন) এই উৎসব দুটি পালন করেন মহাসমারোহে। এছাড়াও মুসলমান সম্প্রদায় ঈদেমিলাদুন্নবী, শবেবরাত ইত্যাদি ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলোও পালন করেন উৎসবের আমেজে। দেশের হাজার হাজার খানকা শরীফে ওরশ উপলক্ষেও মেলা ও উৎসবের আয়োজন হয়। দেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষেরা তাঁদের দেব-দেবীসহ ধর্মীয় ও সামাজিক বহুধরনের উৎসবে সারা বছরব্যাপী নানা আয়োজনে থাকেন মুখর। এরই ধারাবাহিকতায় সুন্দরবন অঞ্চলের সনাতন হিন্দু ধর্মীয় সম্প্রদায় জন্মাষ্ঠমী, দোলযাত্রা, রথযাত্রা, নামসংকীর্তন, অষ্টমী স্নান, বারুনী স্নান, গঙ্গা স্নান, গাজন, চরক, শিবপুজা, মনসাপুজা, কালীপুজা, লক্ষীপুজা, সরস্বতীপুজা, বিশ্বকর্মাপুজা, কার্তিকপুজা, পৌষসংক্রান্তি, চৈত্রসংক্রান্তি এবং সব থেকে বড় শারদীয় দুর্গাপুজা পালন করে থাকেন। এই উৎসবগুলো পালন উপলক্ষে বাংলাদেশের শত শত স্থানে নানা ধরনের মেলা বসে। এই মেলাগুলো কৃষিজাত নানা পণ্য সম্ভারে সাজানো থাকে। বাংলাদেশের বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের নিকট পূর্ণিমা পবিত্রতার প্রতীক। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীগণ মাঘী পূর্ণিমা ও আষাঢ়ী পূর্ণিমা পালন করেন। এ উপলক্ষে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে বিশেষ করে চট্টগ্রাম, রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি, কক্সবাজার, বান্দরবান, এবং বরগুনা জেলার বি স্নান ভিন্ন স্থানে মেলা বসে। বাংলাদেশের খ্রিস্টান সম্প্রদায় বড়দিন পালন করেন আনন্দমুখর পরিবেশে। এ উপলক্ষে বরিশালের পাদ্রী শিবপুর, ঢাকার নবাবগঞ্জের বান্দুরা, গাজীপুর জেলার কালীগঞ্জ, গোপালগঞ্জ জেলার মকসুদপুরের কালিগ্রামে মেলার আয়োজন হয়ে থাকে। বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় শতাধিক বছরের পুরাতন অনেকগুলো ঐতিহ্যবাহী মেলা এখন অবধি নিয়মিত অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। এদেশের ইতিহাস ঐতিহ্য ও লোক সংস্কৃতির ধারক এই মেলাগুলোর আকার ও বিষয় বৈচিত্রে অত্যন্ত বৃহৎ এবং সমৃদ্ধ। উল্লেখ করার মতো মেলাগুলো হলো: সূর্যমুনি মেলা (বরিশাল), কেল্লাপোশী মেলা (শেরপুর বগুড়া), দুরমুট মেলা (জামালপুর), বারদী মেলা (নারায়নগঞ্জ), দারোয়ানীর মেলা (নীলফামারী), রথের মেলা (ঢাকা), মুহরমের মেলা (কিশোরগঞ্জ), মনসারমেলা (আগৈলঝরা-বরিশাল), ভোকাট্টা মেলা (বিয়ানী বাজার সিলেট), গুরপুকুরের মেলা (সাতক্ষীরা), কানসাটের মেলা (চাঁপাইনবাবগঞ্জ), খেতুরের মেলা (রাজশাহী), বাঘার মেলা (রাজশাহী), রাসমেলা (কান্তজীর মন্দির প্রাঙ্গন-দিনাজপুর), কালীপুজার মেলা (নাটোর), নেকমরদের মেলা (রাণী শংকৈল, ঠাকুরগাঁও), খাঞ্জেলীর মেলা (বাগেরহাট), মাছের মেলা ( শেরপুর মৌলভীবাজার), ঘোড় দৌড়ের মেলা (মাগুড়া), মাইজভান্ডারীর মেলা (ফটিকছড়ি চট্টগ্রাম), পোড়াদহ মাছের মেলা (গাবতলী বগুড়া), সীতাকু-ের মেলা (চট্টগ্রাম), লালন মেলা (কুষ্টিয়া), মতুয়া মেলা (ওড়াকান্দি গোপালগঞ্জ), বোথড়ের চড়ক মেলা (চাটমোহর পাবনা), রথের মেলা (রাজশাহী শহর), বারুনী স্নানের মেলা (চিলমারী কুড়িগ্রাম)।
ধানের নানামুখী ব্যবহার শুধু বাঙালি সংস্কৃতিতে সীমাবদ্ধ নয় বিশ্বে ধান উৎপাদনকারী সকল জনগোষ্ঠীর মধ্যেই ধানের বিভিন্ন রকম ব্যবহার রয়েছে। বর্তমানে বিশ্বে বাংলাদেশসহ ৮৯ টি দেশের প্রধান আবাদি ফসল হলো ধান। এদের প্রধান খাদ্য ভাত। বিশে^র মোট জনসংখ্যার অর্দ্ধেকেরই প্রধান খাদ্য ভাত ও চাল থেকে প্রস্তুত খাদ্য সামগ্রী। ধান থেকে চাল আর চাল সেদ্ধ করে হয় ভাত। আমাদের দেশে অতীত কাল থেকে কয়েকটি প্রবাদ চালু রয়েছে- যেমন, ‘মাছে ভাতে বাঙালি,’ ‘ভেতো বাঙালি,’ ‘ডাল ভাতে বাঙালি,’ ইত্যাদি। বাঙালির বুঝ ভাতে। অন্য অনেক কিছুর ঘাটতি সহনীয় হলেও- বাঙালি ভাতের অভাব মেনে নিতে নারাজ। বাঙালি শুধু ভাতই খায়না - ধান ও চাল থেকে অনেক ধরনের রকমারি খাদ্য তৈরি করে নিজেদের খাদ্য ভুবনকে করে তুলেছে বৈচিত্র্যময় এবং সমৃদ্ধ। ধান থেকে সরাসরি তৈরি হয় খৈ। চাল থেকে হয় মুড়ি, চিড়া, বিভিন্ন ধরনের পিঠা, ফিরনি, পায়েস, রুটি, তেহারী, পোলাও, বিরিয়ানী ইত্যাদি। মুড়ি, চিড়া ও খৈ থেকে নানা ধরনের মোয়া নাড়– ইত্যাদি শুকনো খাবার তৈরি হয়। খৈ থেকে হয় মুড়কি। বাংলাদেশ সহ পার্শ্ববর্তী দেশের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ও পাহাড়ী আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মধ্যে ভাত পচিয়ে এক ধরনের দেশী মদ তৈরি করার রেওয়াজ অতীত কাল থেকেই চালু রয়েছে। এদের তৈরি দেশী মদ (চাল থেকে) স্থানীয়ভাবে ‘চুয়ানী’ বা ‘হাড়িয়া’ নামে অভিহিত। ইদানিং চালের তুষ থেকে তেল তৈরি হচ্ছে, যা খাদ্য হিসেবে অত্যন্ত পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ। এক সময় সমগ্র বাংলার কৃষক ও শ্রমজীবী মানুষের অন্যতম প্রধান খাদ্য ছিল পান্তাভাত। পান্তাভাত খাওয়া বাঙালির জীবনে স্বচ্ছলতার প্রতীক নয়। আসলে নিম্ন আয়ের ব্যাপক জনগোষ্ঠীকে বিগত শতাব্দীর সত্তরের দশকের শেষাবধি পান্তাভাত খেতে হয়েছে। সমগ্র বাংলাদেশের প্রায় সকল গ্রামেই দেখা যেতো প্রতিটি বাড়ির পেছনে রয়েছে কলাগাছ। সবরি কিংবা সাগর কলার গাছ নয় - শুধু বিচে কলার (আঁটিয়া কলা) গাছ। কারণ একটিই - পান্তা ভাতের সঙ্গে এই জাতের কলা ছিল মানানসই। এই ছিল সমগ্র দেশের ব্যাপক জনগোষ্ঠীর বৈষয়িক জীবনের আসল চিত্র। দেশে উচ্চ ফলনশীল ধান এসে অর্থনীতিকে অনেকটাই গতিশীল করেছে সত্য, তবে ইরি বা ব্রী ধানের ভাতের পান্তা মানুষ গ্রহণ করেনি। কারণ উফশী ধানের ভাতে পচন ধরে যায় ৪ থেকে ৫ ঘন্টার মধ্যেই। বিগত শতাব্দীর সত্তর দশকের শেষ দিক থেকেই দেশের শ্রমজীবী মানুষের মধ্যে সকাল বেলায় গরম ভাত অথবা রুটি খাওয়ার অভ্যাস গড়ে উঠেছে। অনেকে চিড়া, মুড়ি মুড়কি ইত্যাদি সকালের নাস্তা হিসেবে ব্যবহার করে থাকেন। শহরাঞ্চলে বসবাসকারী নাগরিকবৃন্দ অহরহই চাল থেকে প্রস্তুত মুড়ি, চিড়া, ফিরনি, পায়েস, পোলাও, তেহারী, বিরিয়ানী, নানা ধরনের পিঠা, পুলি, মুড়ি চিড়া ও খৈ থেকে প্রস্তুত মোয়া, চালের পাপড়, চালবাজার নাড়– ইত্যাদি খাচ্ছেন। এদের অধিকাংশের ধারণা যে কোন ধানের চাল থেকেই এগুলো তৈরি হয়ে থাকে। এই ধারনা মোটেও সঠিক নয়। যেমন মুড়ি তৈরির জন্য নির্দিষ্ট কিছু ধানের জাত রয়েছে। অনুরূপ ভাবে চিড়া এবং খৈ তৈরির জন্য রয়েছে নির্দিষ্ট অনেক ধানের জাত। এছাড়া পোলাও, বিরিয়ানী, তেহারী, ফিরনী ও পায়েস সহ নানা ধরনের মিষ্টান্ন তৈরির জন্যও রয়েছে অনেকগুলো নির্দিষ্ট জাতের ধান। সব ধানের চালের গুড়া থেকে পিঠা তৈরি হয় না। পিঠা-পুলির জন্যও রয়েছে নির্দিষ্ট কিছু জাতের ধান। নির্দিষ্ট ধানের চাল ব্যতীত প্রচলিত নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়ে ঢালাও ভাবে কোনো খাদ্য দ্রব্য প্রস্তুত হতে পারে, তবে সেটি কোনোভাবেই মানসম্মত হবে না। আদিগঙ্গার তীরবর্তী কলিকাতা, সুতানুটি এবং গোবিন্দপুর এই তিনটি গ্রাম নিয়ে গড়ে উঠেছিল বর্তমান কালের কলকাতা শহর। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর বণিক দলপতি জব চার্ণক ১৬৯০ খ্রিস্টাব্দে তার জাহাজ সহ আদি গঙ্গা তীরবর্তী সুতানুটি গ্রামে অবতরণ করেন। ২৭ এপ্রিল ১৬৯০ খ্রিস্টাব্দে ভারতে বাণিজ্য করার ফরমান স¤্রাট কর্তক লাভ করেন। ১৬৯৮ খ্রিস্টাব্দে স¤্রাট আওরঙ্গজেবের পৌত্র ওসমানের নিকট থেকে ১৬,০০০ হাজার টাকার বিনিময়ে কলিকাতা, সুতানুটি এবং গোবিন্দপুর এই তিনটি গ্রাম পত্তনী নেন। তিনটি গ্রামের বাৎসরিক খাজনা নির্দ্ধারিত হয় ১,২৮২.৬০ টাকা। তিনটি পাশাপাশি গ্রামের আয়তন ছিল লম্বায় তিন মাইল এবং প্রশস্ততা ছিল এক মাইল। বর্তমানে কলকাতা শহরের গড়ের মাঠ নামে পরিচিত বিশাল স্থানটি গোবিন্দপুর গ্রামেরই একটি অংশ।
৬.৩ নদী ও জীবন
নদীর দেশ বাংলাদেশ। পদ্মা, মেঘনা, যমুনা (ব্রহ্মপুত্র) কর্ণফুলী, সুরমা, তিস্তা, কপোতাক্ষ, গড়াই, কালিন্দী, মহানন্দা, ধলেশ^রী, বরাকসহ অসংখ্য ছোটোবড়ো নদ-নদী আমাদের দেশকে জালের মতো ছেয়ে রেখেছে। বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত ৫৭টি আন্তর্জাতিক নদীর ৫৪টির উৎপত্তি হিমালয়সহ ভারতের অন্যান্য উৎস থেকে। বাংলাদেশের মিঠাপানির মাত্র ৭ ভাগ পাওয়া যায় বৃষ্টিপাত থেকে, আর বাকি ৯৩ ভাগ আসে সীমান্তের ওপার থেকে বৃষ্টি ও বরফ গলনের মাধ্যমে। ১৯৭৪ সালে ফারাক্কা বাঁধ চালুর পর থেকে পদ্মা অববাহিকা অঞ্চলে প্রায় ৩০ টি নদী মরা নদীতে পরিণত হয়েছে। এককালে বড়ো নদীগুলো দিয়ে ৩২৮ হাজার থেকে ১৪২ হাজার কিউসেক পানি প্রবাহিত হতো। শুষ্ক মৌসুমে গঙ্গা-কপোতাক্ষ অঞ্চলের ২ লাখ হেক্টর জমিতে সেচের পানি থেকে বঞ্চিত, ফলে শস্য উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় খাদ্যসংকট দেখা দেয়। উজানে অতিবৃষ্টি এবং হিমালয়ের বরফ গলার কারণে অতিরিক্ত পানির চাপ কমানোর জন্য হঠাৎ করে সবগুলো নদীর বাঁধ খুলে দেওয়ার ফলে ফসল, জান-মাল এবং ভয়াবহ ভাঙনে প্রতিবছর কোটি কোটি টাকার ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়। শুষ্ক মৌসুমে অতিরিক্ত পানির চাহিদা পূরণ করতে গিয়ে গভীর নলকূপের ব্যবহার করায় পানির স্তর ক্রমেই নেমে যাওয়ায় অগভীর নলকূপে প্রয়োজনীয় পানি না ওঠায় অধিক ফলনশীল ইরি ও বোরো ধানের চাষ ব্যাহত হয় এবং পরিবেশগত বিপর্যয় দেখা দেয়। ফারাক্কা বাঁধের ফলে মিঠাপানির চাপ কমে যাওয়ায় দক্ষিণাঞ্চলের নদীসমূহে লবণাক্ততার অনুপ্রবেশ ঘটছে। উপকূলবর্তী নদীগুলোর লবণাক্ততা ইতোমধ্যে ৬০ ভাগ বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে ঘোষিত বিশে^র বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদের সমাহার সুন্দরবনে ইতোমধ্যেই পরিবেশগত বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। ফারাক্কা বাঁধের কারণে পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলাতেও ইতোমধ্যে ধ্বংসাত্মক বন্যা, ভাঙন এবং জলাবদ্ধতার ক্ষতি ভয়াবহ রূপ লাভ করেছে। পানি প্রবাহ ব্যাহত হওয়ার কারণে বাংলাদেশের নদীগুলো বিপুল পরিমাণ পলি বহন করতে না পারায় মাইলের পর মাইল ধুধু বালুচর সৃষ্টি হচ্ছে। ভারতের আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পের ফলে বাংলাদেশের অস্তিত্বও হুমকির সম্মুখীন। উজানের নদীগুলো থেকে পানি প্রত্যাহারের ফলে দেশের প্রায় সবগুলো নদ-নদীই ক্রমে মরা নদীতে পরিণত হয়েছে। ভারতের আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থী। ১৯৯৭ সালে গৃহীত আন্তর্জাতিক পানি প্রবাহ কনভেনশনের ৭ (১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, প্রতিটি দেশ আন্তর্জাতিক পানি প্রবাহ থেকে পানি ব্যবহারের সময় পাশর্^বর্তী দেশ যাতে কোনোরূপ ক্ষতির সম্মুখীন না হয় সে জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। ভারতের আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প জাতিসংঘের পানি প্রবাহ কনভেনশনের (১) অনুচ্ছেদেরও সুস্পষ্ট লংঘন। ভারতের এক তরফা পানি প্রত্যাহারের ফলে সুদূরপ্রসারী প্রতিক্রিয়ায় দেশের অস্তিত্ব বিপণ্নের পাশাপাশি পরিবেশগত বিপর্যয়, জীববৈচিত্র্য বিনষ্ট, জলজ প্রাণীর আবাসভূমি ধ্বংস এবং সুন্দরবনের স্বাভাবিক অস্তিত্বের বিনাশ হতে চলেছে।
সরকারীভাবে স্বীকৃত বাংলাদেশের ছোটোবড়ো ৭১০ টি নদীর মধ্যে ৫৭ টি নদীই আন্তর্জাতিক, যার ৫৪ টি ভারত বাংলাদেশের মধ্যে অবস্থিত। ২০১৫ সালের হিসেব অনুযায়ী ভারত-নেপাল থেকে বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত পানির পরিমাণ বার্ষিক গড়ে ১০ লাখ ৭৩ হাজার ১৪৫ মিলিয়ন ঘনমিটার। অভ্যন্তরীণ বৃষ্টিপাত থেকে বার্ষিক ২ লাখ ৫০ হাজার ৪০১ মিলিয়ন ঘনমিটার পানি বাংলাদেশের নদী-নালা-খাল-বিল জলাশয়গুলোতে জমা হয়ে থাকে। বরাক-মেঘনা, ব্রহ্মপুত্র-যমুনা ও গঙ্গা-পদ্মা নদীর মধ্য দিয়ে যথাক্রমে ১৫০ বিলিয়ন ঘনমিটার, ৭০০ বিলিয়ন ঘনমিটার ও ৫০০ বিলিয়ন ঘনমিটার পানি প্রবাহিত হয়। পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের অভিন্ন নদীর সংখ্যা ৫৪ টি। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে যৌথ নদী কমিশনের তালিকার বাইরেও ৪২ টি নদ-নদীর মধ্যে ৩৭ টি নদী সরাসরি ভারতের সীমা অতিক্রম করে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। এই নদীগুলোর পতিত মুখ বাংলাদেশের অভ্যন্তরেই। গভীরভাবে উপলব্ধি করলে দেখা যায় যে তিনটি পরিকল্পনা সামনে রেখে ভারতের নদী ব্যবস্থাপনা পরিচালিত। প্রথমত, কৃষিজমিতে সেচ ব্যবস্থার সম্প্রসারণ; দ্বিতীয়ত, জলবিদ্যুৎ উৎপাদন; তৃতীয়ত, বন্যা নিয়ন্ত্রণ। এছাড়াও বিভিন্ন প্রকল্পের ফলে অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ ব্যবস্থার ব্যাপক উন্নয়ন, পানের উপযোগী স্বাদু পানি সরবরাহ প্রকল্প স্থাপন এবং পর্যটন ক্ষেত্র সম্প্রসারণ। ভারতের নদীসমূহ বিভিন্ন উৎস থেকে পানির প্রবাহ লাভ করে থাকে। ১. মূল উৎস থেকে প্রাপ্ত প্রবাহ ২. বৃষ্টির পানি ৩. উপনদীর প্রবাহ ৪. ঝরনাধারার পানি এবং ৫. লোকালয় থেকে নর্দমা থেকে দিয়ে গড়িয়ে পড়া পানি। নিজেদের সমৃদ্ধির সোপান গড়ে তুলতে তারা নদীর পানি একস্থান থেকে অন্য স্থানে স্থানান্তরের জন্য খাল বা ক্যানাল খনন, এক নদীর সঙ্গে অপর নদীর সংযোগ সাধন, নদীর উচ্চতম স্থানে ড্যাম তৈরি ও জলবিদ্যুৎ প্রকল্প স্থাপন, ব্যারাজ ও ব্রিজ নির্মাণ, নদীর এক বেসিন থেকে অন্য বেসিনে স্থানান্তর। জানা গেছে, ভারত ইতোমধ্যে (২০১৫ সালের পূর্বে) দৃশ্যমান নদ-নদীগুলোর ওপর ৩৬০০ টির অধিক বাঁধ বেঁধে ফেলেছে। ২০১৫ সাল থেকে নতুন করে অতিরিক্ত ১০০০ বাঁধ নির্মাণের কাজ শুরু করেছে। উজানে ভারত তার বহুসংখ্যক সেচ ও পানিবিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য মূল গঙ্গা এবং এর আশেপাশের উপনদীগুলোর ৯০ ভাগ পানি সরিয়ে নিচ্ছে। কেবল ফারাক্কাই নয়, গঙ্গা-পদ্মাকেন্দ্রিক বাঁধ, জলাধার, ক্রসড্যাম, রেগুলেটরসহ অন্তত ৩৩টি মূল অবকাঠামো নির্মাণ করেছে। এর সঙ্গে রয়েছে আনুষঙ্গিক আরো অসংখ্য ছোটোবড়ো প্রকল্প। উত্তরাখ- রাজ্য সরকার নতুন করে ৫৩টি বিদ্যুৎ প্রকল্প পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছে। ভারত অনেক আগে থেকেই গঙ্গায় বৃহদাকার তিনটি খাল প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে। এরমধ্যে রয়েছে, ‘আপারগঙ্গা ক্যানেল প্রজেক্ট’, ‘মধ্যগঙ্গা ক্যানেল প্রজেক্ট’, এবং ‘নিম্নগঙ্গা ক্যানেল প্রজেক্ট’।’ এরূপ প্রকল্পের হাজার হাজার কিলোমিটার খালের মাধ্যমে তারা গঙ্গার পানি সরিয়ে নিয়ে সেচ দেবার ব্যাপক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। এসব ক্যানেল প্রকল্প চাঙা রাখতে নিয়মিতভাবে গঙ্গার পানি প্রত্যাহার করা হচ্ছে। ভারতের ভিতরে গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র নদের পানির উৎস বৃদ্ধির সহায়ক উপনদীগুলোতেও বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। বাংলাদেশে পানির জন্য হাহাকার থাকলেও ফারাক্কায় পানি না থাকার অজুহাতে বাংলাদেশকে পানি বঞ্চিত করা হচ্ছে। প্রকৃত বাস্তবতা হলো ভারত অনেক আগে থেকেই ভেতর থেকে উজানে বাঁধ দিয়ে নদীগুলোকে বন্ধ্যা করে রেখেছে। ইন্ডিয়া টুডে পত্রিকার তথ্য থেকে জানা যায় ফারাক্কা পয়েন্টে আসার আগেই উজানে উত্তর প্রদেশ ও বিহারে গঙ্গা থেকে ২৫-৪৫ হাজার কিউসেক পানি প্রত্যাহার করা হচ্ছে। ফলে অনিবার্যভাবে ফারাক্কা পয়েন্টে পানির প্রবাহ কমে যাচ্ছে। ভারত-ভুটান-নেপালের পরিকল্পনা অনুযায়ী ৫৫২টি বাঁধকে কেন্দ্র করে সর্বমোট বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্য হচ্ছে ২ লাখ ১২ হাজার ২৭৩ মেগাওয়াট। নির্মম বাস্তবতা হলো এই ৫৫২টি বাঁধই বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক নদীগুলোর উজানে। লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী উৎপাদিত বিদ্যুতের এক মেগাওয়াটও বাংলাদেশ পাবে না, অথচ সুন্দরবনসহ সমগ্র বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ পরিবেশ ও জীবিকার ওপর ক্ষতির সম্মুখীন হয় ব্যাপকভাবে। ভারতের উজানে ব্রহ্মপুত্রসহ আন্তর্জাতিক নদীগুলোতে বাঁধ দিয়ে চীন যে ভূ-রাজনৈতিক কৌশলগত খেলা শুরু করেছে, তাতে কেবল ভারতের পশ্চিবঙ্গ এবং পূর্বাংশের রাজ্যগুলিই নয়; বাংলাদেশও অস্তিত্ব সংকটে পড়বে। যেহেতু উভয় দেশের নদ-নদীগুলোতেই পানির স্বাভাবিক প্রবাহ ব্যাহত এবং স্তর ক্রমশঃ নিচে নেমে যাচ্ছে, বিজ্ঞানীদের ভবিষ্যৎ আশংকা অনুযায়ী কখনো যদি এ অঞ্চলে ৮ রিখটার স্কেলে কোনো ভূমিকম্প হয়; তাহলে প্রধান প্রধান নদ-নদীগুলোর গতিপথ পরিবর্তিত হয়ে যাবে, বিপর্যয়ের মুখে পড়বে উভয় বাংলার নদীকেন্দ্রিক ভূ-প্রকৃতি, জীববৈচিত্র্য, মানবগোষ্ঠী, সভ্যতা ও সংস্কৃতি। আন্তর্জাতিক, আঞ্চলিক এবং দ্বিপাক্ষিক পর্যায়ে গভীর বিশ্লেষণ করে উভয় দেশকে সম্মিলিত পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে। নেপাল, ভুটান, মিয়ানমার, ভারত, চীনকে নিয়ে একটি আঞ্চলিক নদী কমিশন গঠন করতে হবে। জাতিসংঘ ঘোষিত নদী কমিশনে ভারত ও বাংলাদেশের স্বাক্ষর করা অতীব জরুরি। বিশ^ব্যাংক ঘোষিত ১৯৯১ সালে গৃহীত নীতিমালা অনুযায়ী পরিবেশের ক্ষতি হতে পারে এমন ধরনের যে কোনো প্রকল্পের.. পরিবেশগত প্রভাব নিরূপণ করার শর্ত বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। বিশ^ব্যাংক এবং জাতিসংঘকে বাংলাদেশের পরিবেশগত বিপর্যয়ের এই ক্ষয়ক্ষতির প্রভাব সম্পর্কে অবহিত করে জাতিসংঘের মাধ্যমেই বাংলাদেশকেও এই বিপর্যয় থেকে রক্ষার প্রকল্প গ্রহণে অগ্রসর হওয়া জরুরি। তবেই, সুন্দরবনসহ উভয় দেশের ভূ-প্রকৃতি, নদী, পরিবেশ ও মানবতার সুরক্ষা হবে।
৬.৪ পটের গান
‘পট গান’ বাংলাদেশের দক্ষিণ জনপদের মানুষের অপূর্ব এক সৃষ্টি। এখন থেকে আনুমানিক প্রায় দুইশ বছর পূর্বে এই অঞ্চলের গ্রামের বাড়ীতে বাড়ীতে গিয়ে এই পটগান গেয়ে শোনানো হতো এবং চাউল সংগ্রহ করা হতো। পটের চিত্রে হাতে আঁকা বড় বড় ছবি থাকতো, সেগুলি বাড়ীর উঠানে বিছিয়ে দেয়া হতো এবং একে একে ছবিগুলির কাহিনী বা ঘটনা পর্যায়ক্রমে গানের সুরে বর্ণনা করাতো হতো। পটের টিত্রগুলি সাধারণতঃ কুড়ি-পঁচিশ ফুট দীর্ঘ আর দু’তিন ফুট চওড়া এক ধরনের পুরু কাপড় বা কাগজের উপর আঁকানো ছিল। এই পটের চিত্র কোনো শিল্পীর তুলির আঁচড়ে তৈরী নয়, সাধারণ কোনো স্থানীয় ব্যক্তি যার ছবি আঁকার একটু দক্ষতা আছে, এমন কাউকে দিয়ে এ ছবিগুলি আঁকানো। এই ছবি আঁকতে ব্যবহার করা হতো দোয়াতের কালি, আলতার রং বা খড়ি মাটি, তুলির পরিবর্তে ব্যবহার করা হতো খেঁজুরের ডাল দাতনের মতো বানিয়ে। দীর্ঘ চিত্র পটটির দুই প্রান্তে তিন-চার ফুট লম্বা দুটি লাঠি জোড়ানো থাকতো। একটা লাঠিতে রোল করে সুন্দরভাবে প্যাচানো পটটি একজন ঘাড়ে করে এক বাড়ি থেকে অন্য বাড়ি বয়ে নিতো। বাড়ির উঠানে দাঁড়িয়ে, প্যাচানো পটের একটা একটা দীর্ঘ লাঠি দিয়ে চিত্র দেখিয়ে বয়ান গেয়ে যেতেন এবং তার সহ-গায়েনরা মূল বয়ানটা একসঙ্গে গাইতো। প্রত্যেকটি চিত্রের কাহিনী বা ঘটনা দুই পঙ্তি/চরণের যে ভাষ্য তার মাধ্যমে পূর্ণাঙ্গরূপে বর্ণনা লাভ করতো। চরণ দুটিতে কোনো বর্ণনা-বাহুল্য থাকতো না, থাকতো চিত্র রূপময়তা। প্রতি দুই চরণে চিত্র একাধিক থাকতে পারে কিন্তু বক্তব্য একটি। প্রত্যেকটি বক্তব্য বা চিত্রের সঙ্গে অন্য চিত্র বা বক্তব্য বিষয়ের কোনো ধারাবাহিক সঙ্গতি নেই বা কোনো গাঁথা কাহিনীর আদলে পরিবেশিত নয়। সবই প্রায় বিক্ষিপ্ত কিছু আর্থ-সামাজিক চিত্র দৃশ্যমান হয়। সুন্দরবন সংলগ্ন মোংলা অঞ্চলের পটের প্রকারভেদ:
১. সুন্দরবন বিষয়ক পট
২. এইডস্ বিষয়ক পট
৩. ফাদার রিগান ও সেন্ট পলস হাই স্কুল
৪. রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র
৫. আলোঘর প্রকল্প (কারিতাস)
৬. উন্নত চুলা আবিষ্কার (ভেনাস)
৭. দক্ষিণ অঞ্চলের পট (মোংলা এলাকা)
ঐ বাড়ি ছিল রে এক মাজাকুঁজো বুড়ি।
ছাগোল বানতি নিয়ে গেল চৌদ্দ বোঝা দড়ি ॥
অথবা:
ছোট্ট খাট্ট মেঞা ভাই মুখে চাঁপা দাঁড়ি।
পাক্কা ধানে গরু দিয়ে হুক্কা টানে বাড়ী ॥
উল্লেখিত প্রথম অংশের পটগানের বক্তব্য অনুসারে আমরা পটের ছবিতে দেখতে পাই মাজা কুঁজো গ্রামের এক বৃদ্ধা অনেকগুলো ছাগল তাড়িয়ে নিয় চলেছে এবং তার কোমরে করে বয়ে নিয়ে যাচ্ছে বোঝা- বোঝা দড়ি। অনুরূপ দ্বিতীয় অংশের পটচিত্রে দেখতে পাই মুখে চাঁপা দাড়িওয়ালা একজন মানুষ ঘরের দাওয়ায় বসে হুকা টানছে এবং অদূরে মাঠে পাঁকা ধানক্ষেতে তার গরুগুলি ধান খাচ্ছে। বাংলাদেশের দক্ষিণ অঞ্চলের আঞ্চলিক সহজ সরল ভাষায় এই পটের গানগুলি রচিত। স্থানীয় লোকজনই তাদের দেখা সামাজিক ঘটনা-কর্মকা- থেকেই এই পটগানগুলি রচনা করেছেন এবং প্রজন্ম পরস্পরায় মানুষের মুখে মুখে পটের বয়ান বেঁচে থেকেছে এবং যুগ যুগ ধরে গেয়ে এসেছে। লক্ষ্যনীয় বিষয় এই যে, এখানে ব্যবহার করা হয়েছে মধ্যযুগীয় পয়ার ছন্দের ছাদ। প্রত্যেক পঙ্তি বা চরণে আট+ছয় মাত্রার দুই পর্ব করে এবং প্রতি দুই চরণের অন্তে রয়েছে মিল। প্রায় ক্ষেত্রেই চৌদ্দ মাত্রায় এক-একটা চরণ সম্পন্ন হয়েছে। তখনকার দিনে সমাজ জীবনে মানুষের ঘর-গৃহস্থলি, পূজা-পার্বন, উৎসব-অনুষ্ঠান, বিভিন্ন সংক্রান্তির মেলা, ঘোড়া দৌড়, পুতুল নাচ, বায়স্কোপ ইত্যাদি বিষয়ের আকর্ষনীয় কিছু কিছু দিকের উল্লেখ পাওয়া যেত ঐ সব পটগানে সাত গেরামের সাত ঘোড়া পাল্লা বেঁধে গেলো।
বারেক মিঞার খুড়ী এসে কলসী নিয়ে গেলো ॥
আবার কখনও কখনও সমাজের অপেক্ষাকৃত নিম্নবর্ণের মানুষের কথাকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের সাথে বর্ণনা করা হয়েছে এবং বয়ানকারের অজান্তেই যেন তার বয়ানে উপমা যুক্ত হয়ে গেছে:
নিম গাছে টিমটিম বরই গাছে বাসা।
নিমাই/ আদাড়ে মুচির ছল হইছে চিংড়ে মাছের খোসা ॥
‘জলে কুমির ডাঙ্গায় বাঘ’ এই কথাটি এই অঞ্চলের বাস্তবচিত্র। বিভিন্ন পটের বয়ানে এ সব হিং¯্র প্রাণীর উল্লেখ পাওয়া যায়। সুন্দরবনের অভ্যন্তরে বয়ে যাওয়া অসংখ্য খাল-নালায় নোনা পানির ভয়ংকর কুমির, ডাঙ্গার জঙ্গলে অজগর, বারচিতা, গোলবাঘা, গোখ্রো, বোঁড়া, দোঁড়া বিভিন্ন প্রজাতির সাপ এ সব চারপাশে নিয়েই এ অঞ্চলের মানুষের বসবাস ছিল। পটগানেও তার উল্লেখ পাওয়া যায়। যেমন:
সুন্দরবনের বাঘরে ভাই চোখ পাক্কাইয়ে চায়।
সামনে একটা মানুষ পেলে অমনি ধরে খায় ॥
অথবা
আড়ো মোংলা দিয়ে রে ভাই কুমির ভাসে যায়।
বুড়ো দুডো মানুষ থুয়ে জোয়াল ধরে খায় ॥
কিংবা
মাটে সাপের কটে বিষ চালে বান্ধা ঠুসি।
ছল কামড়াইছে চেনো জোহে মায়ে মরলো বিষি ॥
ও-ওরে দক্ষিণ জনপদ
কত যে সুখ ছিল একদিন, ছিল রে সম্পদ ॥
পট গাই পট গাই পটের পাইনে দিশে।
কোন দিক দিয়ে করি শুরু, কপাল পোড়া মিনশে ॥
গোয়াল ভরা গরু ছিল গোলা ভরা ধান।
নদী ভরা মাছ ছিল কণ্ঠে মধুর গান ॥
বাংলাদেশের দক্ষিণে এই মোংলা উপজেলা।
চারিদিকে ঘিরে যে তার কত নদী নালা ॥
মোংলা নদী, পশর নদী, নদী পুটিমারা।
বঙ্গোপসাগরে তার পড়েছে ¯্রােতধারা ॥
তিন দিকে সুন্দরবন যেন মায়ের কোল।
ঘুম পাড়ানি গান শোনায় বিছিয়ে আঁচল ॥
ঝড় বন্যা প্লাবন এলে ঠেকায় বুক পেতে।
সহায় সম্পদ রক্ষা পায় তাহার কৃপাতে ॥
এই এলাকা ছিল একদিন ঘন সুন্দরবন।
গাছ কেটে, বাঘ তাড়িয়ে বসত স্থাপন ॥
কাছারির নায়েব বলে শুন ধীরেন গোসাই।
বেশী করে জঙ্গল ছাপ করো গো মশাই ॥
বেশী করে বন্দোবস্ত দেব জমাজমি।
না-না বললে চলবে না গো খাজনা সামান্নই ॥
এমনি করে বসত হলো দক্ষিণ জনপদ।
বাপ-দাদার কাঠি-কাটা অমূল্য সম্পদ ॥
‘জলে কুমির ডাঙ্গায় বাঘ’ এই কথাটি এই অঞ্চলের বাস্তবচিত্র। বিভিন্ন পটের বয়ানে এ সব হিং¯্র প্রাণীর উল্লেখ পাওয়া যায়। সুন্দরবনের অভ্যন্তরে বয়ে যাওয়া অসংখ্য খাল-নালায় নোনা পানির ভয়ংকর কুমির, ডাঙ্গার জঙ্গলে অজগর, বারচিতা, গোলবাঘা, গোখ্রো, বোঁড়া, দোঁড়া বিভিন্ন প্রজাতির সাপ এ সব চারপাশে নিয়েই এ অঞ্চলের মানুষের বসবাস ছিল। পটগানেও তার উল্লেখ পাওয়া যায়। যেমন:
সুন্দরবনের বাঘরে ভাই চোখ পাক্কাইয়ে চায়।
সামনে একটা মানুষ পেলে অমনি ধরে খায় ॥
অথবা
আড়ো মোংলা দিয়ে রে ভাই কুমির ভাসে যায়।
বুড়ো দুডো মানুষ থুয়ে জোয়ান ধরে খায় ॥
কিংবা
মাটে সাপের কটে বিষ চালে বান্ধা ঠুসি।
ছল কামড়াইছে চেনো জোহে মায়ে মরলো বিষি ॥
বাংলাদেশের সর্বদক্ষিণ প্রান্তের উপকূলীয় এলাকায় অবস্থিত মোংলা রামপাল উপজেলা যার দক্ষিণ-পূর্ব-পশ্চিম তিন দিকেই প্রায় ঘিরে আছে সুন্দরবন। বর্তমানের এই মোংলা-রামপাল সহ এই দক্ষিণের জনপদ ছিল ঘন সুন্দরবনে ঢাকা। সম্ভবতঃ অষ্টাদশ শতকের শেষার্ধের দিকে অর্থাৎ বৃটিশ শাসনের প্রারম্ভিক সময়কালে এই এলাকায় বসতি গড়ে ওঠে। ঘন সুন্দরবন কেটে প্রথম এই এলাকায় যারা বসতি স্থাপন করেছিলেন তার এসেছিলেন যশোর-ফরিদপুর থেকে। যেমন:
নড়ালের হাঁতিরে ভাই কুতকুতোয় চায়।
সামনে একটা কলাগাছ পালি ওমনি ভাঙ্গে খায় ॥
পটগানের আর একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো এর প্রাথমকি অংশ বা মুখ্য বোল। এই অংশকে পটের ধুয়াও বলা যেতে পারে। এই অংশটি পয়ার ছন্দে আবদ্ধ নয়। এই ধুয়া গেয়েই শুরু হয় পটের উপস্থাপনা। এই মুখ্য বোলের সুর ছন্দ আর বক্তব্যের মধ্যে সম্পূর্ণ পটটির আভাস অভিব্যক্তির ইঙ্গিত পাওয়া যায়। তাই প্রথমেই প্রকাশ পায় গোটা পটের ঘটনাসমূহ কি দুঃখ- বেদনার কথা বলবে নাকি আনন্দ-উচ্ছ্বাসের কথা বলবে
যেমন ও ওরে নাইয়ের সুখীর মাইয়ে
চাড্ডে ভাত পালাম না চাইয়ে রে নাইয়ের সুখীর মাইয়ে
অথবা:
ও ওরে লাল মোন হীরা মোন তোতা
তোমরা কওনা রসের কথা।
৬.৫ গাজি কালু চম্পাবতীর পালা
বাংলাদেশে গাজির গানের ব্যাপক প্রচলন এর জনপ্রিয়তার স্বাক্ষর বহন করে। দক্ষিণ বাংলার বিভিন্ন জেলা বিশেষ করে খুলনা বিভাগের প্রায় সকল জেলাতেই গাজির গানের আয়োজন লক্ষ করা যায়। এ অঞ্চলের জনজীবনে গাজির গানের প্রভাব খুব বেশি। সুন্দরবনকে কেন্দ্র করেই গাজির গানের বি¯তৃতি। গাজির গানের আলোচনা সুন্দরবন ছাড়া কিছুতেই পূর্ণতা পায় না। অতীতকালে সুন্দরবনের চারপাশের এলাকা ছিল জনবসতির জন্য প্রতিকূল। হিংস্র জীবজন্তু, মহামারী, সমুদ্র, নদী-খাল আর বাদাবন পরিবেষ্টিত এই অঞ্চলের কৃষিজীবী, বনজীবী এবং জলজীবী মানুষের জীবন এবং জীবিকার একমাত্র উৎস ছিল সুন্দরবন। সুন্দরবনের প্রাকৃতিক প্রতিবেশই এদের বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন হওয়ার কারণে প্রকৃতির উপর কর্তৃত্ব, প্রকৃতিকে জয় করার বাসনা , বৈষয়িক উন্নতি, সমৃদ্ধি প্রভৃতি কারণে এ অঞ্চলের জনজীবনে গাজি পিরের উপর নির্ভরতা। গাজি পিরের উপর ভরসা করেই এরা আজও রয়েল বেঙ্গল টাইগার, হিংস্র কুমির এবং বিষাক্ত সাপের মোকাবেলা করে। হিন্দু মুসলিম উভয় সম্প্রদায় গাজি পিরের উদ্দেশ্যে পূজা, শিরনি, ওরস, মেলা প্রভৃতির আয়োজন করে থাকে। গাজি পির এ অঞ্চলের প্রধান লোকদেবতা। লোকসমাজের এই দেবতা বাঙালির জনজীবনে অসাম্প্রদায়িকতার প্রতীকও বটে।
হিন্দুসমাজে বাঘ দেবতা হিসেবে দক্ষিণা রায়ের যে স্থান মুসলিম সমাজে গাজিপিরের সেই স্থান। লোকপূজ্য পির গাজি দক্ষিণা রায়ের পর্যায়ভুক্ত হয়ে হিন্দু ও মুসলিম উভয় সমাজে পূজ্য হয়ে ওঠেন। জনজীবনের মু্িক্তদাতা এই পিরের গান তাদের ধ্যান ও জ্ঞানের উৎস। খুলনার দিঘলিয়া থানার দাসপাড়া নিবাসী অশীতিপর বৃদ্ধ ধীরেন্দ্রনাথ দাস বলেন, গাজীপিরই তাদের জীবনের ভালমন্দ, উন্নতি, অবনতি, ছেলে-মেয়ের বিয়ে, সুখ-শান্তি, সবকিছুর মাঝে অবস্থান করেন, বিধায় এ গান তাদের ধর্মেরই অংশ। এ গান অঞ্চলভেদে গাজির পালা, গাজির গীত, গাজির গাইন, পিরের গান, গাইনের পালা, গাইনেরগীত, গাইনের তামাশা ইত্যাদি নামে পরিচিত। হিন্দু মুসলিম উভয় পরি বারে গাজিপির সমান আসন দখল করে আছেন। নতুন সন্তানের জন্ম হলে গাজির গানের মানত করা হয়। এমনকি পরীক্ষা পাস এবং রোগমু্িক্তর জন্য গাজির গানের আসরের আয়োজন করা হয়। গাজিপিরের জনপ্রিয়তার কারণেই মৌখিক সাহিত্যের পাশাপাশি গাজি পিরকে ঘিরে লিখিত পুথি সাহিত্যের বিকাশ ঘটেছিল বাংলা সাহিত্যে। গাজিপির বিষয়ক সবচেয়ে প্রাচীন পুথির রচনাকাল ১৭৯৮-৯৯ সাল। রচয়িতার নাম পাওয়া যায় কবি খোদা বখ্শ। সৈয়দ হালুমীর ১৮২৭, আবদুর রহিম ১৮৫৩, খোন্দকার মাহমুদ আলী ১৮৭৮, মোহাম্মদ মুন্সী ১৮৯৬ এবং আবদুল গফুর বিশ শতকের গোড়ার দিকে পুথি রচনা করেছিলেন বলে জানা যায়। বর্তমান প্রবন্ধকার খুলনা বিভাগের জেলা সমূহে ক্ষেত্র সমীক্ষার মাধ্যমে লক্ষ্য করেন যে, গাজিপিরের পুথি এবং গাজিপিরের পালার মধ্যে ব্যাপক পার্থক্য রয়েছে। যদিও ধারণা করা হয় পুথি সাহিত্যের ছায়া অবলম্বন করেই পালা কাহিনী সমূহ রচিত হয়েছে। কিন্তু পালা সমূহ সংখ্যায় যেমন প্রাচুর্যের দাবিদার বিষয় বস্তুতে ও তেমনই বৈচিত্র্যমুখী। লোক সমাজ আপন জীবনের অনুকৃতির সাথে সাদৃশ রেখে নতুন নতুন পালা বা গাঁথা তৈরি করেছেন। প্রতিটি পালাতেই গাজিপির এবং কালুর উপস্থিতি থাকলেও ঘটনা এবং চরিত্রের বিস্তৃতির কারনে এর পালা সংখ্যা সুনির্দিষ্ট করে বলা কঠিন। সরেজমিনে দেখা যায় যশোর, কুষ্টিয়া, ঝিনাইদহ প্রভৃতি জেলায় প্রচলিত পালাসমূহের সাথে খুলনা জেলায় প্রচলিত পালাসমূহের ব্যাপক পার্থক্য। তবে উভয় অঞ্চলেই গাজি এবং কালুর উপস্থিতির সাথে ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তি এবং ঘটনার সন্নিবেশ কাঙিক্ষত মাত্রায় পাওয়া যায়। আনন্দ প্রকাশের পাশাপাশি ইহকালীন কল্যাণ এবং পূণ্য প্রাপ্তির অন্তর্নিহিত লক্ষ্য সকল এলাকার লোক সমাজেই বিদ্যমান। তবে, সমগ্র বাংলাদেশেই গাজির সাতটি পালা সমধিক পরিচিত। পালাগুলো হলো :
১. গাজী-কালু-চম্পাবতীর পালা
২. নিজাম ডাকাতের পালা
৩. কাফন চোরার পালা
৪. ভেলুয়া সুন্দরীর পালা
৫. জামাল বাদশার পালা
৬. দিদার বাদশার পালা
৭. বাহরাম বাদশার পালা।
ব্যাপক এবং বৈচিত্র্য মূখী গাজির গানের সকল পালাতেই পাওয়া যায় মূখ্যত-
১. অধ্যাত্মবাদ
২. অসাম্প্রদায়িক চেতনা
৩. আনুগত্য
৪. আত্মসমর্পণ
৫. ইহকালীন কল্যাণ প্রভৃতি।
বাংলাদেশের ফোকলোর গবেষক রওশন ইজদানী গজির গানকে লোককৃত্যমূলক গান অভিধায় ভূষিত করেছেন। গাজির গানের সাথে যুক্ত শ্রোতা এবং গায়েন সম্প্রদায় সমাজের অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে থাকা শ্রেণির মানুষ। এরা সমাজের বিত্তবানদের, কাছে যেমন অবহেলার পাত্র, তেমনই নিপীড়িত। প্রকৃতি এবং জীবনের কাছে এরা এতটাই অসহায় যে, অতিলৌকিক কোনো শক্তির নিকট আশ্রয়গ্রহণ ছাড়া এদের সামনে কোন পথ খোলা নেই। হিন্দু মুসলিম নির্বিশেষে জনসাধারণ পার্থিব বিপদমুক্তির জন্য গাজি পিরের উদ্দেশ্যে মানত করে থাকে। সে অর্থে গাজিপির তাদের ধর্মসমন্বয়ের দেবতার আসন গ্রহণ করেছেন। গাজির উদ্দেশ্যে নিবেদিত পূজা বা বন্দনায় দেবতাতুষ্টির অনুকরণ লক্ষ করা যায়। আঠারো শতক, উনিশ শতক এবং বিশশতকের প্রথমার্ধে বাংলাদেশের প্রায় সর্বত্রই গাজির গান জনপ্রিয় ছিল। এই সময়কার বাংলাদেশে গ্রামীণ মুসলমান সমাজের ধর্মজীবন ছিল ব্যাপকভাবে লৌকিক ধর্মবিশ্বাস দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। সেই সমাজে লৌকিক ধর্মবিশ্বাসের এতোটা প্রভাব ছিলো যে, কখনো কখনো হিন্দু ও মুসলমান সমাজের মধ্য অভিন্ন লৌকিক দেবতার উপস্থিতি ও লক্ষ করা যায়। সত্যনারায়ণ বা সত্যপির এমন এক দেবতা। একই কারণে গাজির কাহিনীতে যথেষ্ট পরিমাণে সাম্প্রদায়িক উপসর্গের উপস্থিতি থাকা সত্ত্বেও মুসলমান সমাজের ন্যায় হিন্দু সমাজে ও বিপদে আপদে গাজিকে স্মরন বা গাজির গানের মানত করার রেওয়াজ আজও প্রচলিত। গাজির গান নিম্ন বিত্ত হিন্দু মুসলমানের সাংস্কৃতিক ব্যবধান কমিয়ে দিয়েছে। গাজির গানের পৃষ্ঠপোষকতায় বিত্তবান হিন্দু বা মুসলমান কেউ এগিয়ে আসেননি। নিম্ন বিত্তরাই শ্রোতা ও পৃষ্ঠপোষক। গায়েনদের কেউ এ গানকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করতে পারেননি। কৃষিজীবী, রিকশাচালক, কারখানার শ্রমিক, দোকানি, দর্জি, রাজমিস্ত্রি, চিংড়িঘেরের শ্রমিক, নৌকার মাঝি, জেলে, তাঁতি, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী প্রভৃতি পেশার সাথে যুক্ত গাজির গানের গায়েন ও পৃষ্ঠপোষকবৃন্দ।২৩ গাজির গানের শ্রাতাদের মধ্যে হিন্দু মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের লোকের সমাগম ঘটে। জনসংখ্যাধিক্যের কারণে মুসলমান পরিবারের শ্রোতাসংখ্যা বেশি। অবশ্য প্রতিটি দলেই গায়েনদের মধ্যে হিন্দু মুসলিম সংমিশ্রণ চোখে পড়ার মতো। কোথাও কোথাও মূল গায়েন হিন্দু সম্প্রদায় ভুক্ত এবং পাশ্বচরিত্র সমূহ মুসলিম সমাজ থেকে আগত। তবে সবচেয়ে বেশি লক্ষনীয় বিষয় হলো বাদকদের অধিকাংশই হিন্দু পরিবার থেকে আগত। ঢোল, বাঁশি, চাটি, মন্দিরা প্রভৃতি বাদকবৃন্দ হিন্দু পরিবারের সদস্য।
খুলনার দিঘলিয়া’র দাসপাড়ায় লক্ষ করা গেছে যে, পালা উপলক্ষে হিন্দু-মুসলিম একই পরিবারে একত্রে খাবার গ্রহণ করেছেন। ধীরেন্দ্রনাথ দাসের বাড়িতে দেখেছি সকল গায়ক দুপুরের খাদ্য গ্রহণ করে একত্রে বিশ্রাম করছেন। এখানে কোনজাত বা সম্প্রদায়গত ব্যবধান সামনে আসেনি। শ্রোতাসাধারণ গাজিপিরকে অতিলৌকিক ক্ষমতার আধার বলে মনে করেন। তাদের বিশ্বাস গাজি সর্বত্রগামী। রূপ-রূপান্তর বা অশরীরী মূর্তি ধারণ করতে পারেন। প্রাকৃতিক ঘটনা নিয়ন্ত্রণ করে দৈবদুর্র্বিপাক থেকে মানুষকে রক্ষা করতে পারেন। এমনকি মৃত ব্যক্তি এবং বৃক্ষকে পুনরুজ্জীবন দান করার ক্ষমতাও তার রয়েছে। তারা এমন ধারণা পোষণ করেন যে গাজিপির তাদের মনের কথা জানেন এবং ভবিষ্যতের কথা বলে দিতে পারেন। তার দোয়ায় নিঃসন্তানের সন্তান লাভ, অন্ধের দৃষ্টিঅর্জন, রোগীর রোগমুক্তি ক্ষুর্ধাতের ক্ষুধা নিবৃত্তি, পীড়িতের সেবালাভ এবং শত্রুকে জয় করা যায়। তারা আরও বিশ্বাস করেন, গাজি পির আগুন পানির উপর কর্তৃত্ব করে সকল মঙ্গলের হাত থেকে তাদেরকে রক্ষা করেন। গাজিপিরের গানকে তারা পূণ্য অর্জনের উপায় হিসেবে দেখে থাকেন এবং মনে করেন এগানের পরিবেশনার সাথে যুক্ত থাকলে ইহকালীন ও পরকালীন মুক্তিলাভ হয়। গাজির গান যেমন বাঙালির জনজীবনে মুক্তির আকাঙ্খা জাগায় তেমনি তাদের আনন্দ বিনোদনের প্রকাশ ও ঘটে এর মাঝে। কাজেই এ গান সুন্দরবন অঞ্চলের বাঙালি হিন্দু মুসলমানের জনজীবনের স্পন্দন। গাজির গান বাঙালির চিরায়ত লোকনাট্যের ঐতিহ্যকে ধারণ করে এগিয়ে চলে। এর মাঝে পাওয়া যায় কাহিনি, অভিনয় কুশলতা, সংলাপ, কাব্যময় সঙ্গীত এবং কৌতুকপ্রিয়তার সমন্বয়। সাধারণ মানুষের জীবন ভাবনাকে অনুসরন করে কাহিনীর চরিত্রের সুখ-দুঃখের সাথে একাকার হয়ে যায় বাঙালির জীবন। দুঃখ দারিদ্র্যক্লিষ্ট একঘেয়ে জীবনের পীড়ন এবং যন্ত্রনা থেকে সাময়িক মুক্তিলাভের একটি আশ্রয়স্থল এগান। মানত এবং পুণ্য অর্জনের পাশাপাশি আনন্দ উপভোগও এখানে মুখ্য। প্রাত্যহিক কর্মজীবনে এভাবে গাজিরগান প্রভাব ফেলে মানবচিত্তকে জয় করে থাকে। বাঙালীর শিক্ষা ও শাস্ত্র জ্ঞানের গভীরতার যে অপূর্ণতা সে অপূর্ণতাকে পরিপূর্ণ করে দেয় উদার চিত্ত ও সাম্প্রাদায়িক সম্প্রীতিমূলক সহাবস্থান। তাইতো এ জাতির লোকসঙ্গীত, পালাগান, ছড়া, বিশ্বাস-সংস্কার, প্রবাদ প্রবচন, কিংবদন্তি, ব্রত কৃথা প্রভৃতির মাধ্যমে নিজস্ব চিন্তার প্রকাশ ঘটে। রোগ শোকপীড়িত ও অভাব অূনটনের মাঝে সেবা, সাহায্য, অনুগ্রহ কামনায় গাজির গানকে অনুষঙ্গ বিবেচনা করে বাঙালি, আর এভাবেই গাজিরগান হয়ে ওঠে জনজীবনের অনুকৃতি।
৭. শেষকথা
সুন্দরবন আজও নতুন বৃক্ষ-ফুলে সুশোভিত হয়; আজ দুইটি ভৌগোলিক সীমানায় বিভক্ত সে, তা বলে খণ্ডিত নয়। আজও সে মিলনের ধারা বয়, কাঁটাতার আর লাইট-পোস্টে কুয়াশারা আটকায় না, আটকায়না মধুপায়ী মৌমাছির চাকগড়া; আটকায়না বাঙালির মিলনের স্রোত। রাজনৈতিক সাম্প্রদায়িক কিউসেকে আজও গঙ্গার পানি মাপা হয়। এপাড়ে ওপাড়ে ফুল-ফসল আর বৃক্ষ মরে তৃষ্ণায়। সাধ বাড়ে, স্বপ্ন বাড়ে। আশা জাগে আবার বাংলা তৃষ্ণার জল পাবে, বাংলা হবে প্রতি বাঙালির আত্মপরিচয়ের ভাষা। সুন্দরবন ধারণ করে আছে বাঙালির হারিয়ে যাওয়া সভ্যতার উত্থান পতনের প্রাচীন ইতিহাস। বিভিন্ন খনন কার্যের সময় বেরিয়ে আসে প্রাচীন মন্দির, প্রাচীর, পুকুর, কাঁচা টাকার ঘট, কলসি, গণ্ডারের খোলস, তাম্র মূর্তি, শিলালিপি, সীলমোহর, পাথর, প্রতিমা প্রভৃতি। ১৯০৯ খ্রিষ্টাব্দে খুলনার দৌলতপুরে ব্রজলাল কলেজের পুকুর খনন করতে গিয়ে মাটির অভ্যন্তরে প্রায় ৩০ ফুট দীর্ঘ সুন্দরী গাছ পাওয়া যায়। কলকাতার নিকটবর্তী হুগলী নদীর কাছাকাছি এলাকাগুলোতেও খননকালে এমন সুন্দরী বৃক্ষের দেখা মেলে বলে বিভিন্ন লেখক জানিয়েছেন। সুন্দরবন অঞ্চল থেকে সংগৃহীত অনেক দুর্লভ উপকরণ ঢাকা এবং কলকাতা জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে। ভারতের কাদ্বীপ থেকে আরম্ভ করে বাংলাদেশের বাখরগঞ্জ নোয়াখালী জেলা পর্যন্ত জনবসতির বিভিন্ন স্তরে নবরতœ মন্দির, সূর্যমূর্তি, মাতৃকা মূর্তি, গড়, দূর্গ, জাহাজঘাটা, শিব মন্দির, বিষ্ণু মন্দির প্রভৃতির ধ্বংসাবশেষ, দীঘি-পুষ্করনি সরোবরাদির নিদর্শন মেলে। সুন্দরবনের পশ্চিম অংশে ভারতের সাগরদ্বীপ, সাগর সংগম; রামায়ণ মহাভারতে সাগর সংগমের উল্লেখ সুন্দরবন সম্পর্কে আগ্রহী করে তোলে। এখানেই রয়েছে পদ্মপুরাণে উল্লেখিত চন্দ্রবংশীয় রাজা সুষেনের রাজ্যভুক্ত কপিল মুনির আশ্রম। সুন্দরবন কেবল মৎস্য, কাঁকড়া, মীণ, কাঠ এবং মধু সংগ্রহের মাধ্যম হিসেবে জীবিকার উৎস আর সরকারের রাজস্ব বৃদ্ধির যোগানদাতা নয়, যুগে যুগে প্রাকৃতিক দূর্যোগ থেকে রক্ষা করে চলেছে বঙ্গভূমিকে। উত্তর হিমালয়ের পামির মালভূমি যদি পৃথিবীর ছাদ হয়ে থাকে, তবে সুন্দরবন বঙ্গভূমির সুরক্ষা অয়োময় বা লৌহপ্রাচীর। সুন্দরবনকে রক্ষার দায়িত্ব সকলের, সুন্দরবন বিশ্বের প্রাকৃতিক সম্পদ। উন্নয়নের নামে এমন কোনো অপরিণামদর্শী প্রকল্প গ্রহণ করা উচিৎ নয়, যা জীববৈচিত্র্য ও সুন্দরবনকে হুমকির সম্মুখীন করে।