দেশ ও জাতির কল্যাণে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর ভূমিকা ও দায়বদ্ধতা
আপনাকে যদি প্রশ্ন করা হয়,"বিশ্ববিদ্যালয় কী ও বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ কী?" আপনি তখন কী উত্তর দিবেন? যদি উত্তর জানা থাকে তাহলে আপনি উত্তর দিতে পারবেন কিন্তু বেশিরভাগ মানুষকে যদি উক্ত প্রশ্নটি করা হয় তবে তারা বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ে যান।চলুন বিশ্ববিদ্যালয় কী ও বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ সম্পর্কে কিছু তথ্য আজকে আমরা জেনে নেই যাতে আমাদের এমন বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে না হয়।
" একটি দেশ ভালো হয় যদি সে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ভালো হয়। " -পণ্ডিত জওহার লাল নেহেরু।
‘বিশ্ববিদ্যালয়’ শব্দটি লাতিন ইউনিভার্সিতাস (universitas) শব্দের কৃতঋণ অনুবাদ। মজার বিষয় হলো বিদ্যা, বিদ্যায়তন বা উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে লাতিন ইউনিভার্সিতাস শব্দের ন্যূনতম যোগসূত্রও ছিল না। ইউনিভার্সিতাস শব্দের মূল অর্থ একত্রকরণ, সংঘ, সমিতি বা গিল্ড ছিল। মধ্যযুগে নাপিত থেকে শুরু করে বিভিন্ন পেশাজীবীর সংঘ বা গিল্ড লাতিনে ইউনিভার্সিতাস নামে অভিহিত হতো। লাতিনে করপোরেশন, মিউনিসিপ্যালিটিকেও ইউনিভার্সিতাস বলা হতো। বিশ্ববিদ্যালয়ের সন্ধিবিচ্ছেদ হচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয়= বিশ্ব+বিদ্যালয় । বিশ্ববিদ্যালয়ের শব্দটির উৎপত্তি সংস্কত শব্দ থেকে। বিশ্ববিদ্যালয় শব্দটির অর্থ বিবিধ বিষয়ে উচ্চতর শিক্ষা, গবেষণা ও ডিগ্রি প্রদানের ক্ষমতাপ্রাপ্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।যে প্রতিষ্ঠানে প্রজ্ঞার চর্চা হয়; প্রজ্ঞার সৃজন সঞ্চালন হয় তা-ই বিশ্ববিদ্যালয়।
বিশ্ববিদ্যালয় বিদ্যাচর্চা ও জ্ঞান সৃজন ও সঞ্চালনের প্রতিষ্ঠান; যার কর্মী শিক্ষককে হতে হবে বিদ্বান ও জ্ঞানী। বিশ্ববিদ্যালয় জ্ঞান এবং কেবলই জ্ঞান উৎপাদনের একটি কারখানা ছাড়া আর কিছু নয়।এখানে অধ্যাপক ও ছাত্রছাত্রীরা মিলে তাদের যৌথ পাণ্ডিত্য ও গবেষণা দ্বারা নিত্যনতুন জ্ঞান সৃষ্টি করবেন এবং পুরনো জ্ঞানকে পরিমার্জন ও পরিবর্তন করবেন অথবা অটুট রাখবেন। মোটকথা, বিশ্ববিদ্যালয় হলো এমন একটি প্রতিষ্ঠান যেখানে উচ্চ শিক্ষা প্রদান করা সহ বিভিন্ন ধরনের গবেষণামূলক কাজকর্ম করা হয়ে থাকে এবং সাধারণত স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর উভয় সম্মান প্রদান করে। বিশ্ববিদ্যালয়ে জ্ঞানের চর্চার পাশাপাশি জ্ঞানের উৎপত্তিও ঘটে থাকে।বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল কাজ হলো জ্ঞান বা বিদ্যা সৃষ্টি করা এবং এই জ্ঞান বা বিদ্যাকে মানুষের মধ্যে বিতরন করা । বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেকটি কাজ হলো, মুক্তির প্রণোদনা সৃষ্টি করা।
জন হেনরি নিউম্যান বিশ্ববিদ্যালয়-ভাবনা তাড়িত হয়ে বই লিখেছিলেন The Idea of a University (লন্ডন : লঙ্গম্যান্স গ্রিন, অ্যান্ড কো., ১৯০৭)। জার্মান কূটনীতিক, দার্শনিক ও শিক্ষাবিদ উইলহেলম ভন হামবল্ট (১৭৬৭-১৮৩৫) ১৮১০ সালে একটি মেমোরেন্ডামে লিখেছিলেন,
স্বশাসন—এ তিনের সমন্বয়ে গড়ে উঠতে পারে একটি পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়।
আল-কারাওইন বিশ্ববিদ্যালয় পৃথিবীর বুকে গড়ে ওঠা সর্বপ্রথম বিশ্ববিদ্যালয়। মরক্কোর ফেজে গড়ে ওঠা এটি প্রাচীন সময়ের উচ্চশিক্ষা কেন্দ্র। ইউনেস্কো এবং গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস অনুসারে, মরক্কোর ফেজে অবস্থিত আল-কারাওইন বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্বের প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয়। এটি ৮৫৭-৮৫৯ সালে ফাতিমা আল ফিহরি দ্বারা একটি মসজিদ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং পরবর্তীকালে ঐতিহাসিক মুসলিম বিশ্বের অন্যতম প্রধান আধ্যাত্মিক ও শিক্ষাকেন্দ্র হয়ে ওঠে। পশ্চিমা দেশগুলোয় উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের উন্মেষ ঘটেছিল মধ্যযুগীয় স্কুল থেকে, যেগুলোকে বলা হতো ‘Studia generalia’। মহাদেশের আনাচে-কানাচে থেকে এসব বিদ্যালয়ে ছাত্ররা পড়তে আসত চার্চের পাদ্রি, পুরোহিত ও সন্ন্যাসী হওয়ার জন্য। আরো নির্দিষ্ট করে বলা যায়, ১০৭৯ সালে পোপ সপ্তম গ্রেগরি (১০২০-১০৮৫) ইউরোপের বিভিন্ন জায়গায় ক্যাথিড্রাল স্কুল স্থাপনের জন্য বিশেষ ডিক্রি জারি করেছিলেন। ওই স্কুলগুলোই ছিল সেই অঞ্চলের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থার সূতিকাগার। মধ্যযুগে ইউরোপের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ছিল অনেকটা ধর্ম ও ধর্মতত্ত্ব পড়ানোর কেন্দ্র। যেমন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় ছিল চার্চের মত। ইউরোপের অনেক আগে ভারতবর্ষে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল নালন্দা, বিক্রমশীলা ও তক্ষশীলা বিশ্ববিদ্যালয়। ইতিহাস থেকে জানা যায়, নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় চতুর্থ শতাব্দীর শেষের দিকে অথবা পঞ্চম শতাব্দীর শুরুর দিকে প্রতিষ্ঠিত হয়, যা ছিলো তক্ষশিলার পরেই এশিয়ার সর্বাধিক প্রাচীন ও প্রথম আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়। এশিয়ার অন্যতম সমৃদ্ধ এ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা হয় ৪১৩ খ্রিস্টাব্দে।গুপ্ত রাজবংশ কর্তৃক নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং গুপ্ত রাজবংশের প্রথম চন্দ্রগুপ্ত অথবা সমুদ্রগুপ্ত বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বলে মনে করা হয়।
জ্ঞানের আালোক জ্বালিয়ে রাখা, বিদ্যার পুষ্টিসাধন করা গৌরবময় নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় ১১৯৭ সালে তার অস্তিত্ব হারিয়ে ফেললো যখন পশ্চিমা বিশ্বের বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সবে প্রতিষ্ঠিত হতে শুরু করেছে। নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংস করার মাধ্যমে জ্ঞানের উৎপত্তি ও তার বিস্তরণও যেন পূর্ব থেকে পশ্চিমে স্থানান্তরিত হলো। ১৯৫১ সালে নালন্দা মহাবিহারের ধ্বংসাবশেষের কাছে বিহার সরকার প্রাচীন মহাবিহারটির অনুকরণে পালি ও বৌদ্ধধর্ম শিক্ষার কেন্দ্র হিসেবে নব নালন্দা মহাবিহার প্রতিষ্ঠা করে। ২০০৬ সালে এটি একটি পরিগণ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বীকৃতি পায়। বিশ্বের বৃহত্তম বিশ্ববিদ্যালয় হল ভারতের ইন্দিরা গান্ধী ন্যাশনাল ওপেন ইউনিভার্সিটি (IGNOU)। এটিতে 7.1 মিলিয়নেরও বেশি শিক্ষার্থী নথিভুক্ত হয়েছে, এটি তালিকাভুক্তির মাধ্যমে বিশ্বের বৃহত্তম বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হয়েছে। IGNOU হল একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় যা উন্মুক্ত এবং দূরত্ব শিক্ষার কোর্স অফার করে।
বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ মূলত তিনটি শ্রেণীতে ভাগ করা হয়েছে:
আন্তর্জাতিক (আন্তর্জাতিক সংগঠন কর্তৃক পরিচালিত) বিশ্ববিদ্যালয়।
১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়, যা দেশের প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয়।বাংলাদেশে শুধুমাত্র ৪ টি স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়।
বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের অধিভুক্ত; যা গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের রাষ্ট্রপতি আদেশ (১৯৭৩ সালের পি.ও. নং ১০) অনুযায়ী গঠিত একটি কমিশন। বিশ্ববিদ্যালয় চিন্তার স্বাধীনতা আর বুদ্ধির মুক্তির কেন্দ্র। কেননা চিন্তার স্বাধীনতা আর বুদ্ধির মুক্তি না হলে আলোকিত মানুষ তৈরি হয় না। বিশ্ববিদ্যালয় হবে ভিন্নমতের চারণক্ষেত্র। স্বাধীন চিন্তা বিকাশে ভিন্ন মতের পোষকতার বিকল্প নেই। সাম্প্রতিক সময়ে মানসম্মত বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিধিতে আছে শিক্ষণ, গবেষণা, প্রকাশনা ও প্রশিক্ষণ; এবং যা অবশ্যই বিশ্বমানের হতে হবে। গবেষণা একটি বিশ্ববিদ্যালয়কে বিশ্বের সঙ্গে সংযুক্ত করে। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক শুধু প্রজ্ঞা-সংজ্ঞার ফেরিওয়ালা নন, তিনি মনুষ্যত্বের বাতিঘর। তার প্রণোদনায় শিক্ষার্থী শুধু বিদ্বান হবে না, আলোকিত মানুষও হবে।
জন নিউম্যানের ভাষায় শিক্ষকদের থাকতে হবে, ‘philosophical habit of mind’ দর্শন-অভ্যস্ত মন।
অন্যদিকে প্রজ্ঞা ও সংজ্ঞার মিথস্ক্রিয়ার তৈরি শিক্ষকের চিত্ত হবে হিমাদ্রিসম উন্নত; এবং এডওয়ার্ড সাঈদের ভাষায় তিনি সদাসাহসী হবেন, কারও রুষ্টতা ও তুষ্টতার তোয়াক্কা না করে তার কাজ হবে ‘speak truth to power’। আচার্য (ইংরেজি: Chancellor) হচ্ছেন একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান বা সভাপতি। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি নির্ভর করে উপাচার্যের গুণ-মান-দক্ষতার ওপর।আচার্য মানে প্রভূত জ্ঞানের অধিকারী; উপাচার্য তার কাছাকাছি। উপাচার্য জ্ঞানী হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার অন্যতম একটা লক্ষ্য হচ্ছে গবেষণা ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে উৎকর্ষ সাধন। বিশ্ববিদ্যালয়ের উল্লেখিত লক্ষ্য পূরণের জন্য মুক্ত-জ্ঞানের চর্চার কোনো বিকল্প নেই। আর এজন্য প্রয়োজন অনুকূল পরিবেশ ও প্রণোদনা।
যেখানে চিন্তার মাধ্যমে নতুন জ্ঞান সৃষ্টি করে শিক্ষার্থীদের চিন্তাশক্তির বিকাশ ঘটানো হবে। এর সাথে একজন শিক্ষার্থীর মানবিক মূল্যবোধ জাগ্রত করে তার মধ্যে উদার দৃষ্টিভঙ্গির মনোভব গড়ে তুলতে হবে। আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্প-সাহিত্য, আর্ট, কলা, সামাজিক বিজ্ঞানের বিস্তৃত বিষয়াবলীসহ এক কথাই সবই বিশ্ববিদ্যালয়ের সৃষ্টি। বিশ্ববিদ্যালয়ের আসল কাজ গবেষণা। তার মধ্যে দিয়ে নতুন জ্ঞানের সৃষ্টি করা। শুধু গবেষণা ও শিক্ষাদান নয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের আসল কাজ সুনাগরিক গড়ে তোলা। আগামী নেতৃত্ব সৃষ্টি করা।হাজারো স্বপ্ন নিয়ে একজন শিক্ষার্থী আসে স্বপ্নের বিশ্ববিদ্যালয়ে। লক্ষ্য একটাই নিজেকে মাতৃভূমির কল্যাণে নিবেদিত করার জন্য প্রস্তুত করা। নিজের স্বদেশপ্রেম, আচার-আচরণ সাবলীল করা, অন্যের কল্যাণে এগিয়ে যাওয়া। সাধারণ জনগনের টাকা দিয়ে যে বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা পড়ছি, কয়েক লক্ষ্য শিক্ষার্থীর সঙ্গে ভর্তি যুদ্ধ করে যে বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার জন্য যে প্রচেষ্ঠা সেটা আমাদের কী শিক্ষা দিচ্ছে তা কী কখনো চিন্তা করেছেন? একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হিসেবে দেশ ও জাতির কল্যাণের জন্য আমাদের কী কী দায়িত্ব ও কতর্ব্য রয়েছে এবং জনগনের মঙ্গলের জন্য আমাদের কী কী করণীয় হতে পারে তা কী কখনো আমরা ভেবে দেখেছি? দেশ ও জাতিকে দেওয়ার মতো কী আমাদের কিছুই নেই? আসুন দেশ ও জাতির কল্যাণে সকলে একযোগে কাজ করি এবং সুন্দর পৃথিবী গড়ি।