চন্দ্রকুমার দে, ময়মনসিংহ গীতিকা সংগ্রাহক, সাহিত্য রসিক মহলে একটি পরিচিত নাম। ভয়াবহ দারিদ্র্য এবং প্রতিকূল পরিবেশের বিরুদ্ধে সফল সংগ্রাম করে চন্দ্রকুমার দে জীবন সাধনায় ও বাণী সাধনায় এক অনন্য দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন। তিনি ১৮৮১ খ্রিস্টাব্দে (অথবা ১৮৮৯ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে) নেত্রকোনা জেলার কেন্দুয়া থানার আইথর (আইয়র) গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম ছিল রামকুমার দে এবং মাতার নাম ছিল তারাসুন্দরী (কুসুমকামিনী) দে।
পরিবারের বাস্তুভিটা হারানো এবং অকাল মৃত্যুর কারণে চন্দ্রকুমার দে ছোটবেলায় পিতামাতাকে হারান। এরপর তিনি আর্থিক অসংগতির জন্য সাধারণ লেখাপড়ার সুযোগ পাননি, তবে গ্রামের টোলে শিক্ষা লাভ করেন এবং ব্যক্তিগত চেষ্টায় বাংলা ভাষার উপর ব্যুৎপত্তি অর্জন করেন। তিনি প্রথমে মুদিখানায় চাকরি করেন এবং পরে গোমস্তার চাকরিতে যোগ দেন।
গোমস্তা হিসেবে খাজনা আদায়ের জন্য গ্রামে গ্রামে ঘুরতে গিয়ে তিনি বিভিন্ন গ্রামের গান, গীতিকা, বারমাসী, পুরাণ, এবং পাঁচালী সংগ্রহ করতে শুরু করেন। এসব গান ও গীতিকা পরবর্তীতে তিনি "সৌরভ" পত্রিকায় প্রকাশ করেন, যা ময়মনসিংহের সাহিত্য সাধকদের জন্য এক বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে পরিচিত ছিল।
চন্দ্রকুমার দে'র প্রথম প্রকাশিত রচনা ছিল "মহিলা কবি চন্দ্রাবতী", যা ১৩২০ সনের "সৌরভ" পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এর মাধ্যমে তিনি কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য দীনেশচন্দ্র সেনের দৃষ্টিতে পড়েন এবং তার সহানুভূতি অর্জন করেন।
১৯২১-২৩ সাল পর্যন্ত তিনি প্রায় ২৫টি পালাগান সংগ্রহ করেন যা পরবর্তীতে "পূর্ব মৈমনসিংহ গীতিকা" এবং "পূর্ব বঙ্গ গীতিকা" তে স্থান পায়। তার সংগ্রহ করা গীতিকাগুলোর মধ্যে মহুয়া, মলুয়া, চন্দ্রাবতী, কমলা, দস্যু কেনারামের পালা ইত্যাদি গীতিকাগুলি সাহিত্য গুণে উৎকৃষ্ট।
চন্দ্রকুমার দে তার গীতিকা সংগ্রহ, কবিগান, লোকসাহিত্য এবং ফোকলোর বিষয়ে অসাধারণ পরিশ্রম করেছেন। তাঁর "প্রাচীন সাহিত্যের অন্বেষণে" রচনাটি এ সময়ের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যকর্ম হিসেবে বিবেচিত। তার সংগ্রহ করা উপাদানগুলোর মধ্যে প্রবাদ, ছড়া, মন্ত্র, এবং লোককথা উল্লেখযোগ্য।
চন্দ্রকুমার দে'র সংগ্রহ ও গবেষণার কাজ ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এক অমূল্য দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে, এবং তাকে ফোকলোরের সাধক হিসেবে চিরস্মরণীয় রাখা হবে।
তিনি ১৯৪৬ সালে ময়মনসিংহে মৃত্যুবরণ করেন।
তথ্যসূত্র: বাংলাদেশের ফোকলোর সাধক; মোঃ জাহাঙ্গীর হোসেন; ২০০৭