দীনেশচন্দ্র সেন: বাংলা সাহিত্যের মহান সংগ্রাহক ও গীতিকা সম্পাদক

User

শিক্ষার্থী , Rajshahi University

Honours 4th year


রেজী:
BCW24120005

প্রকাশিত:
২৫ এপ্রিল ২০২৫

আপডেট:
২৫ এপ্রিল ২০২৫

  

 

 

 

 


 
"দীনেশচন্দ্র সেন: বাংলা সাহিত্যের মহান সংগ্রাহক ও গীতিকা সম্পাদক"


দীনেশচন্দ্র সেন ১৮৬৬ সালের ৩ রা নভেম্বর মানিকগঞ্জের বগজুড়ি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম ঈশ্বর চন্দ্র সেন এবং মাতার নাম রূপলতা দেবী। দীনেশচন্দ্র সেনের ছোটবেলা থেকেই কবিতা, ছন্দ, সাহিত্য এর প্রতি প্রবল উৎসাহ ছিল। সাত বছর বয়সে দেবী সরস্বতীকে নিয়ে পয়ারে লিখেছিলেন স্তব মন্ত্র। তাঁর মতে, সাত বছর বয়সে প্রথম কবিতা "সরস্বতীর স্তব" রচনার মধ্য দিয়ে তাঁর সাহিত্যিক জীবনের শুরু।

পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর প্রথম কবিতার নাম "জলদ"। তিনি ১৮৮২ সালে জগন্নাথ স্কুল থেকে এন্ট্রান্স পাশ করেন। ১৮৮৪ সালে ঢাকা কলেজ থেকে এফ.এ পাশ করেন এবং ১৮৮৯ সালে বি.এ ডিগ্রি লাভ করেন। ১৮৮৭ সালে সিলেটের হবিগঞ্জ স্কুলে শিক্ষকতা দিয়ে তাঁর কর্মজীবন শুরু হয়। ১৮৯০ সালে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া স্কুলের প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালনকালে গ্রাম বাংলার বিভিন্ন অঞ্চল ঘুরে প্রাচীন বাংলার পুঁথি সংগ্রহ করেন। সামাজিক সংস্কারের জন্য পুঁথিগুলো সংগ্রহ করাও ছিল দুঃসাধ্য। তিনি এই দুঃসাধ্য কাজ করার জন্য সারা বাংলাদেশ চষে বেড়িয়েছেন এবং সহস্রাধিক পুঁথি সংগ্রহ করে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস রচনা করেন।

এমনিভাবে অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে তাঁর অক্ষয় কীর্তি "বঙ্গভাষা ও সাহিত্য" প্রকাশ পায় ১৮৯৬ সালে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই বইটির প্রশংসা করেন। গ্রন্থখানি প্রকাশ করেছিল ত্রিপুরার রাজা বীরচন্দ্র মানিক্য দেব বর্মন। এই জন্য দীনেশচন্দ্র সেন কৃতজ্ঞতাবশত তা রাজাকেই উৎসর্গ করেন। তিনি এই গ্রন্থ রচনা করতে গিয়ে অনেক পরিশ্রম করেন, এবং এর জন্য তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। সাহিত্যিক মহলে তাঁর আসন সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। অতএব, কুমিল্লায় অবস্থানকালটা তাঁর জীবনের এক বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।

১৯০০ সালের শেষার্ধে তিনি ফরিদপুর থেকে কলকাতা প্রত্যাবর্তন করেন। "বঙ্গভাষা ও সাহিত্য" তখন তাঁকে সাহিত্য ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠা দান করেছে। ১৯০১ সালে "বঙ্গভাষা ও সাহিত্য" এর দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হলে চারিদিক থেকে প্রশংসার পুষ্পবৃষ্টি হতে থাকে। ১৯০০ সালে জুন মাসে প্রখ্যাত ঐতিহাসিক রজনীকান্ত গুপ্তের মৃত্যু হয়। তাঁর স্থলে বি.এ. পরীক্ষায় বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ভাষার পরীক্ষক নিযুক্ত হবার আশায় দীনেশচন্দ্র তদানীন্তন ভাইস চ্যান্সেলর স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের শরণাপন্ন হন। তাঁর আবেদন অগ্রাহ্য হয়নি। এই সময় থেকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে তাঁর সম্পর্কের সূত্রপাত হয়। আশুতোষ দীনেশচন্দ্র সেনকে সুনজরে দেখেছিলেন, ফলে তাঁর অনুকম্পায় দীনেশচন্দ্র সেনের কর্মক্ষেত্র ক্রমশ সম্প্রসারিত হতে থাকে।

১৯১১ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর বই "History of Bengali Language and Literature"। দীনেশচন্দ্র সেন ১৯০৯ ও ১৯১৩ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের রীডার হন। তারপর "রামতনু লাহিড়ী" অধ্যাপকের পদ অলংকৃত করেন। ১৯২১ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাকে ডি.লিট. উপাধি দিয়ে সম্মানিত করেন; গভর্নমেন্টও এই সময় তাকে "রায়বাহাদুর" খেতাবে ভূষিত করেন।

দীনেশচন্দ্র সেনের ওপর যখন অর্পিত হয় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ উন্নয়নের দায়িত্ব, তখন তিনি বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস প্রণয়নের সঙ্গে সঙ্গে ফোকলোরের প্রতি দৃষ্টি দেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফোকলোর বিষয়ক পঠন-পাঠন ও গবেষণায় দীনেশচন্দ্র সেনের অবদান অনেক। সারা বাংলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ফোকলোরের একটি বিশিষ্ট উপাদান গীতিকা সংগ্রহের উপর তিনি সর্বপ্রথম গুরুত্ব প্রদান করেন। গীতিকা হলো সংগীতাকারে বর্ণিত কাহিনী। গীতিকা আখ্যানধর্মী লোকসাহিত্য। আবৃত্তির পাশাপাশি এটি গীত হয় এবং প্রকাশভঙ্গিতে থাকে লৌকিক বৈশিষ্ট্য।

তিনি গীতিকা সংগ্রহের জন্য নিয়োগ প্রদান করেন আশুতোষ ভট্টাচার্য, চন্দ্রকুমার দে এর মতো সুযোগ্য সংগ্রাহকদের। এর সঙ্গে যুক্ত করেন কবি জসীম উদদীন, বিশ্বেশ্বর ভট্টাচার্য, বসন্তরঞ্জন রায়ের মতো নিষ্ঠাবান সংগ্রাহকদের। স্বল্পকালের মধ্যেই এদের সাহায্যে সংগৃহীত হয় ফোকলোরের অসংখ্য দুর্লভ সম্পদ। দীনেশচন্দ্র সেন সংগ্রাহকদের নানা প্রয়োজনীয় উপদেশ দিয়েছেন, জোর দিয়েছেন যাতে সংগ্রাহকরা প্রত্যক্ষ ক্ষেত্র থেকে অবিকৃতভাবে লোকসাহিত্যের উপাদান সংগ্রহ করেন।

গীতিকা সংগ্রহের পর এগুলোর সংকলন ও সম্পাদনার জন্য অর্থ সংগ্রহও একটি বড় ব্যাপার হয়ে দেখা দিয়েছিল। তাই গীতিকা সংগ্রহের দুঃসাধ্য কাজের মতো দীনেশচন্দ্র সেনকে অর্থ সংগ্রহ করতে হয়েছে সরকারি মহল থেকেও। দীনেশচন্দ্র সেন অসাধারণ নিষ্ঠা, পাণ্ডিত্যের সঙ্গে এগুলো সম্পাদনা করে একের পর এক কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশ করতে থাকেন।

গীতিকা গুলোকে বিশ্বের দরবারে পরিচিত ও প্রতিষ্ঠিত করার জন্য তিনি স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের শরণাপন্ন হন। স্যার আশুতোষের আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতায় তিনি এগুলোর অনুবাদ করেন এবং পরবর্তীতে তাঁরই সম্পাদনায় "Eastern Bengal Ballads - Mymensingh" এর প্রথম খণ্ড প্রকাশিত হয় ১৯২৩ সালে। এর দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ খণ্ড প্রকাশিত হয় যথাক্রমে ১৯২৬, ১৯২৮ ও ১৯৩২ সালে।

বাংলা সাহিত্যের উপাদান তথা লোকসাহিত্য সংগ্রহ করা ছিল ড. দীনেশচন্দ্র সেনের আজীবনের সাধনা। পূর্ববঙ্গের মুখোমুখি প্রচলিত লোকগীতি অবলম্বনে "The Folk Literature of Bengal" (১৯২০) ও "পূর্ববঙ্গ গীতিকা" তাঁর লোকজ সংস্কৃতি প্রীতির পরিচয় বহন করে। এ গ্রন্থগুলো সুদূর ফরাসী দেশের সুধীমহলে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সমর্থ হয়েছিল।

নিম্নে দীনেশচন্দ্র সেনের কিছু পালা তুলে ধরা হলো:

মৈমনসিংহ গীতিকায় ১০টি গীতিকা স্থান পেয়েছে, যথা: 

  1. মহুয়া
  2. মলুয়া
  3. চন্দ্রাবতী
  4. কমলা
  5. দেওয়ান ভাবনা
  6. দস্যু কেনারামের পালা
  7. রূপবতী
  8. কঙ্ক ও লীলা
  9. কাজলরেখা
  10. দেওয়ানা মদিনা

মৈমনসিংহ গীতিকা প্রকাশিত ও সমাদৃত হওয়ার পরে দীনেশচন্দ্র সেন ময়মনসিংহ, নোয়াখালি, চট্টগ্রাম প্রভৃতি অঞ্চল থেকে আরও অনেক গীতিকা সংগ্রহ ও সম্পাদনা করে পূর্ববঙ্গ গীতিকা (১৯২৬) নামে মোট তিন খন্ডে প্রকাশ করেন।

পূর্ববঙ্গ গীতিকায় উল্লেখিত কিছু পালা তুলে ধরা হলো:

  • ধোপা পাঠ
  • মহিষাল বন্ধু
  • ভেলুয়া
  • কমলারাণীর গান
  • দেওয়ান ঈশা খাঁ
  • ফিরোজ খাঁ দেওয়ান
  • আয়না বিবি
  • শ্যামরায়ের পালা
  • শীলাদেবী
  • আঁধা বন্ধু
  • বাগুলার বারমাসী
  • রতন ঠাকুরের পালা
  • পীর বাতাসি
  • জিবালনি
  • সোনারায়ের জন্ম
  • ভাড়াইয়া রাজার কাহিনী ইত্যাদি

শুধু গীতিকার সংগ্রহ বা সম্পাদনার ক্ষেত্রেই দীনেশচন্দ্র সেনের ফোকলোর চর্চায় অবদান সীমাবদ্ধ ছিল না। এক্ষেত্রে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফোকলোর পঠন-পাঠনের কথা স্মরণ করা যায়। "Folk Literature of Bengal" গ্রন্থে তিনি লোকসাহিত্য নিয়ে বিশদ আলোচনা করেছেন। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস গবেষণায় সাহিত্যকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে অধ্যয়নের উপযোগী করে গ্রন্থ প্রণয়নে এবং সংকলন ও সম্পাদনার মাধ্যমে লোকসাহিত্যের বিশ্বপরিমণ্ডলে জনপ্রিয় করে তোলার ক্ষেত্রে অন্যতম পথ প্রদর্শক ছিলেন দীনেশচন্দ্র সেন।

১৯৩৯ সালের ২০ শে নভেম্বর কলকাতার বেহালায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

 

 


তথ্যসূত্র:

  • বাংলার ফোকলোর সাধক; উদয় সংকর বিশ্বাস; ২০১৪
  • বাংলাদেশের ফোকলোর সাধক; মোঃ জাহাঙ্গীর হোসেন; ২০০৭