বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮৯৩ সালের ২৩ শে জুলাই, বেঙ্গলী একাডেমী অব লিটারেচার নামে। এটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল কলিকাতার শোভাবাজারে, রাজা বিনয়কৃষ্ণ দেব বাহাদুরের নিজ বাসভবনে। এটা এমন একটি প্রতিষ্ঠান যেখানে বাংলা ভাষা, শিল্প - সাহিত্য নিয়ে আলোচনা, পর্যালোচনা এই ধরনের কাজ করা যায়, সেই রকম উৎসাহী কিছু ব্যক্তি মিলে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ। তাঁরা মূলত ফরাসি একাডেমী বা বিভিন্ন দেশের যে লিটারেচার একাডেমী তার আদলে সাধারণত এই প্রতিষ্ঠানটিকে গড়ে তোলার চেষ্টা করে। বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ প্রতিষ্ঠার পর থেকে একটি গবেষণামূলক পত্রিকা বের করে। পত্রিকাটির নাম "বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ পত্রিকা" এটি ছিল ত্রৈমাসিক পত্রিকা, যা তিন মাস পর পর চারটা সংখ্যায় বার হতো বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ এ। বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ এর প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এই সাহিত্য পরিষৎ এর ইংরেজি নাম "বেঙ্গলী একাডেমী অব লিটারেচার" এর পরিবর্তে বাংলা নাম রাখার প্রস্তাব দেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি বলেছিলেন, "বেঙ্গলী একাডেমী অব লিটারেচার না বলে, আমরা এর একটা সুন্দর বাংলা নামকরণ করতে পারি।" পরে এটির নাম "বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ" হয়। পরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর আরেকটি প্রস্তাবে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ এর প্রধান দপ্তর বা সংগঠনের প্রধান আশ্রয়স্থল শুধু কলকাতা কেন্দ্রীয় না রেখে বাংলার বিভিন্ন অংশে এটির শাখা রাখার প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরেন। বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ১৮৯৩ সালে, আর ১৮৯৪ সালে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ পত্রিকায় প্রথম ফোকলোরের লেখা পাওয়া যায় এবং এটির লেখক হচ্ছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তাঁর প্রবন্ধের শিরোনাম ছিল "ছেলে ভুলানো ছড়া"। অন্যদিকে বসন্ত রঞ্জন রায়ের প্রবন্ধের শিরোনামও "ছেলে ভুলানো ছড়া", যা এই পত্রিকায় পাওয়া যায়। আবার এই পত্রিকায় অম্বিকাচরণ গুপ্তের প্রবন্ধ প্রকাশিত হয় যার শিরোনাম ছিল "ছড়া"। এছাড়াও আরেকজন বিখ্যাত ব্যক্তির ছড়া বিষয়ক প্রবন্ধ এই পত্রিকায় পাওয়া যায়, তিনি হলেন আব্দুল করিম সাহিত্য বিশারদ। তাঁর প্রবন্ধের শিরোনাম ছিল "চট্টগ্রামী ছেলে ভুলানো ছড়া"। বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ তাদের সদস্যদের মধ্যে দিয়ে বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে পাঁচালী সংগ্রহ করেছিল। এই পাঁচালীগুলো ছিল হাতে লেখা। পাঁচালী সাধারণত কোনো দেব - দেবীর মাহাত্ম্য প্রচারের জন্য লেখা হয়। যেমন : শনির পাঁচালী, শ্রাবণ সংক্রান্তি ইত্যাদি যেসব পাঁচালী বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ সংগ্রহ করেছিল সেগুলো হল : * মঙ্গলচন্দী * লক্ষ্মীচন্দ্র ব্রত * সত্যপীরের পাঁচালী * সূর্যপূজা * সত্য নারায়ণ পাঁচালী * পাঁচু ঠাকুর পাঁচালী ও * দাশরথি রায়ের পাঁচালী বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ পুরনো পুঁথি সাহিত্য সংগ্রহ করেছিল এবং এটি এই সংগঠনটির একটি ভালো দিক। বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ এর বার্ষিক সম্মেলন হয় বিভিন্ন জায়গায়। যেমন : * এটির প্রথম বার্ষিক সম্মেলন হয় ১৯০৭ সালে বহরমপুরে ( বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ)। * ১৯০৯ সালে এই সংগঠনটির দ্বিতীয় সভা হয় রাজশাহীতে। * ১৯১০ সালে ভাগলপুরে ( ভারতের বিহারের একটি রাজ্য) এই সংগঠনটির তৃতীয় সম্মেলন হয়। * ১৯১১ সালে ময়মনসিংহে এই সংগঠনটির চতুর্থ সম্মেলন হয়। * ১৯১২ সালে এটির পঞ্চম সম্মেলন হয় চুঁচুড়ায় ( ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান বিভাগের অন্তর্গত হুগলি জেলার একটি মহকুমা) বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ কর্তৃক প্রকাশিত বিষয় ভিত্তিক প্রবন্ধগুলো হলো : * ছড়া বিষয়ক * প্রবাদ - প্রবচন বিষয়ক * ধাঁধা বিষয়ক * পাঁচালী বা মঙ্গলকাব্য বিষয়ক * লোকক্রীড়া বিষয়ক * লোককাহিনী বিষয়ক * লোকাচার বিষয়ক * লোকসংগীত বিষয়ক * লোকদেবতা বিষয়ক * আঞ্চলিক শব্দ বা লোকভাষা বিষয়ক * লোকশিল্প বিষয়ক * পুঁথি বিষয়ক * বিবিধ প্রবন্ধ বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এক ধরনের জাতীয়তাবাদী ভাবনা থেকে। বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ পত্রিকার প্রাবন্ধিকেরা অধিকাংশই সুশিক্ষিত ও উচ্চশিক্ষিত ছিলেন এবং এই প্রাবন্ধিকদের শিক্ষার মধ্যে পাশ্চাত্য প্রভাব ছিল। এই প্রাবন্ধিকদের লেখার গভীরতা, বিচার বিশ্লেষণ এবং সক্ষমতা আমাদের এখনও ভাবায়। তাদের প্রবন্ধগুলো যদি আমরা বিশ্লেষণ করি তাহলে আমরা দেখতে পাব যে অধিকাংশ প্রবন্ধই বর্ণনামূলক। কিন্তু বর্তমানে ফোকলোর চর্চার ক্ষেত্রে বর্ণনামূলক বিষয়টিকে উৎসাহ দেখানো হয়না। তখনকার প্রাবন্ধিকের বর্ণনামূলক প্রবন্ধগুলোকে তাত্ত্বিক বা বিভিন্ন পদ্ধতির যে ধারাগুলো আছে সেভাবে এগুলো বিশ্লেষণ করা হয় নি। কিন্তু এই বর্ণনামূলক প্রবন্ধগুলোকে ছোট করে দেখার কোনো অবকাশ নেই। এই প্রবন্ধগুলোর গুরুত্ব অপরিসীম। কারণ তখন এই ধরনের প্রবন্ধগুলো লেখার রীতি অতটা প্রচলিত ছিল না এবং মানুষের মধ্যে এই ভাবনাগুলো ছিলই না যে প্রবন্ধগুলো আরও বিভিন্ন ভাবে লেখা যায়। গুরুত্বপূর্ণ হবার আরেকটি কারণ হল ঐ সময়ের মানুষের কথাবার্তা, ভাবনা - চিন্তন আমরা জানতে পারছি এখন এই প্রবন্ধগুলোর মাধ্যমে। যদি এই প্রবন্ধগুলো লেখা না হত এবং প্রকাশ না হত তাহলে আমরা জানতেই পারতাম না যে ঐ সময়ের মানুষের কথাবার্তা কেমন ছিল, তাদের চিন্তা - ভাবনাগুলো কেমন ছিল, কোনো একটা লোকশিল্পের উপাদান কিভাবে গড়ে উঠেছে ইত্যাদি অনেক কিছুই আমাদের অজানা থেকে যেত। তাই এটির একটি ঐতিহাসিক গুরুত্ব রয়েছে। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ এর সাথে যুক্ত ছিলেন এবং ১৯০০ সালে অর্থাৎ আজ থেকে প্রায় বিশ বছর আগে তিনি "প্রাচীন বাংলা গ্রন্থাবলি" নামে একটি দ্বিমাসিক পত্রিকা বের করা শুরু করেন। কিন্তু তাঁর এই প্রতিষ্ঠানের সাথে সম্পর্কের অবনতি ঘটার ফলে তিনি আর পরবর্তীতে এই পত্রিকাটি বার করেননি।# বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ এর একটি বড় রকমের প্রকাশনা হল "সাহিত্য সাধক গ্রন্থমালা"। আমাদের এই বাংলা ভাষায় যারা সাহিত্যে লেখালেখি করেন তাদের জীবনীগ্রন্থ বই আকারে এই বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ থেকে বের করা হয়েছে। প্রায় ১৭০ জনের মত লেখকের জীবনীগ্রন্থ বই আকারে এখান থেকে বেরিয়েছে। এই জীবনীগ্রন্থগুলো ছোট পরিসরে অনেক বৈচিত্র্য ও সুন্দরভাবে লেখা হয়েছে। বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ এর আরেকটি ভালো দিক হল ফোকলোর নিয়ে তারা বিভিন্ন বই প্রকাশ করেছে। বিগত দশ বছরে এই সাহিত্য পরিষৎ ভালো কিছু বই বার করেছে। * তার মধ্যে একটি বই হল "ভারতের গ্রাম জীবন" এটির লেখক নির্মল কুমার বসু। * আরেকটি বই হল "পশ্চিমবঙ্গের মন্দির টেরাকোটা" এটির লেখক ইন্দ্রনীল মজুমদার। এমন অনেক বই প্রকাশিত হয়েছে। বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ এর আরেকটি কাজ আমরা দেখতে পাই, তা হল তাদের একটি মিউজিয়াম বা সংগ্রহশালা আছে। তাদের এই সংগ্রহশালায় প্রায় আট হাজার পুঁথি আছে। তার মধ্যে বাংলা পুঁথির সংখ্যা পাঁচ হাজার। বাকি তিন হাজার পুঁথি লেখা হয়েছে সংস্কৃত, তিব্বতী, উড়িয়া, অসমীয়া, হিন্দী ও ফারসি ভাষায়। আট হাজার পুঁথির মধ্যে কিছু পুঁথি ফোকলোরের সাথে যুক্ত। ফোকলোরের সাথে সংশ্লিষ্ট পুঁথির মধ্যে রয়েছে : * "লক্ষ্মী চরিত্র" নামে একটি পুঁথি আছে যেটির সংখ্যা ১৪টি * "সত্য নারায়ণ পাঁচালী" নামক পুঁথি আছে। এটির সংখ্যা ৩৬টি। এটিকে সত্যপীরও বলা হয়। এই লোকদেবতার অবস্থান সুন্দরবন এলাকায়। * "শীতলা মঙ্গলের পাঁচালী" আছে ২টি * "গঙ্গা মঙ্গল পাঁচালী" আছে ২টি * "সূর্যের পাঁচালী" আছে ২টি * "ডাক চরিত্র" আছে ১টি এই সংগ্রহশালায় পুঁথির একটি বড় রকমের সংগ্রহ আছে। পাশাপাশি লোকজ শিল্পের বিভিন্ন কিছু এখানে আছে। বিশেষ করে মুখোশ শিল্পের একটি বড় সংগ্রহ বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ এ আছে। মাটির তৈরি পুতুলের বড় সংগ্রহ রয়েছে এখানে। এছাড়াও বিভিন্ন বিষয়ক টেরাকোটা বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ এর সংগ্রহে রয়েছে। বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ এর কাজকে আমরা দুই ভাবে দেখতে পারি : * একটি হচ্ছে তারা বস্তু কেন্দ্রীক বিভিন্ন উপাদান সংগ্রহ করেছে। সেটি লোকশিল্পের বিভিন্ন উপাদান, হতে পারে সেটি টেরাকোটা, হতে পারে সেটি বিভিন্ন পুঁথি। এই ধরনের জিনিস তাদের সংগ্রহশালায় রয়েছে। * এর পাশাপাশি তারা সাহিত্য কেন্দ্রীক বিভিন্ন কিছু প্রকাশ করেছে। যেমন : প্রবন্ধ, গ্রন্থ ইত্যাদি। এই প্রকাশনার মাধ্যমে আমাদের ফোকলোর অনেক বেশি প্রকাশিত হয়েছে। তথ্যসূত্র : বাংলাদেশের ফোকলোর চর্চার ইতিবৃত্ত; মুহম্মদ আবদুল জলিল; ২০১১