তিস্তা: একটি নদী, একটি জনপদ, একটি বঞ্চনার ইতিহাস

User

শিক্ষার্থী , ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া।

None


রেজী:
BCW25040002

প্রকাশিত:
২৫ এপ্রিল ২০২৫

আপডেট:
২৫ এপ্রিল ২০২৫

 

তিস্তা: একটি নদী, একটি জনপদ, একটি বঞ্চনার ইতিহাস

 

 

তিস্তা একটি প্রবাহমান নদী। বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ নদীগুলোর মধ্যে এটি নানা কারণে বিশেষ অবস্থান দখল করে নিয়েছে। সুদূর নেপালের সিকিম হিমালয়ের ৭,২০০ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত চিতামু হ্রদ থেকে এই নদীর উৎপত্তি। এরপর এটি ভারতের দার্জিলিং জেলার শিভক গোলা নামক গিরিসঙ্কট দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে নীলফামারী জেলার মধ্য দিয়ে।

আমার বাড়ির পাশ দিয়েই এই নদী প্রবাহিত হয়েছে—দূর্ভাগ্যবশত হোক কিংবা সৌভাগ্যবশত। বাংলাদেশ অংশে নদীটির দৈর্ঘ্য প্রায় ১২৪ কিলোমিটার। ফলে আমাদের এই অঞ্চলের পারিবারিক, সামাজিক, ধর্মীয়, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক জীবনে তিস্তার প্রভাব নিঃসন্দেহে গভীর।

প্রাচীন সভ্যতা যেভাবে নদীকেন্দ্রিক গড়ে উঠেছিল বা বিলীন হয়েছিল, ঠিক তেমনি তিস্তার দুই তীরে সময়ের প্রয়োজনে গড়ে উঠেছে জনবসতি। কিন্তু আজ সেই বসতির অস্তিত্বই হুমকির মুখে। ঋতুর পরিবর্তনে বর্ষাকাল যখন আসে, তখন সবচেয়ে নাজুক হয়ে ওঠে পরিস্থিতি। জলবায়ু পরিবর্তন, অনিয়ন্ত্রিত এবং কৃত্রিম বন্যায় নষ্ট হয় পরিশ্রমে গড়া শস্যক্ষেত; ভেঙে যায় পৈত্রিক অথবা কষ্টার্জিত জমি; ডুবে যায় শেষ আশ্রয়স্থলটুকুও। তবুও মানুষ বেঁচে থাকে, নতুন স্বপ্ন দেখে।

কিন্তু অসময়ে আবার সেই ভয়াল মুহূর্ত ফিরে আসে। পরিবর্তন হয় না সর্বহারা মানুষের ভাগ্য। চর জাগলে বলশালীরা লাঠি ও ক্ষমতার দাপটে তা দখলে নেয়। বঞ্চিত হয় গরিব কৃষক। অভাব-অনটনে ভেঙে পড়ে পারিবারিক কাঠামো, ছিন্নভিন্ন হয় পরিবার। জীবিকার খোঁজে তারা ছড়িয়ে পড়ে দেশের নানা প্রান্তে।

তিস্তা নদীকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে নানা মাজার ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান। এসব জায়গা ধর্মীয় মূল্যবোধের চেয়ে কুসংস্কার ও গোড়ামি প্রচারে বেশি ব্যবহৃত হয়। প্রতিপত্তিশালী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান এইসব স্থানের ব্যবহার করে গরিবদের উপর একচেটিয়া শাসন কায়েম রাখে।

এই জনপদের অর্থনীতি মূলত কৃষি ও মৎস্যখাতনির্ভর। বর্ষার ভাঙন, পরিকল্পনাহীনতা ও ভারত-বাংলাদেশের রাজনৈতিক উদাসীনতার কারণে তিস্তায় পর্যাপ্ত পানি না থাকায় মৎস্যখাত চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। উৎপাদিত শস্য ও মাছের সঠিক মূল্য না পাওয়ার পেছনে দালালচক্র, ভ্যাট এবং বিত্তশালীদের অন্যায় আধিপত্য একটি বড় কারণ।

এই অঞ্চলেও কলকারখানা গড়ে তোলা যেত—যা ভূমিহীনদের কর্মসংস্থান, নারীর আর্থসামাজিক উন্নয়ন ও ক্ষমতায়নে সহায়ক হতো। কিন্তু শাসক শ্রেণির উদাসীনতায় তা সম্ভব হয়নি। বর্তমান কিছু উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড দেখা গেলেও তা অপ্রতুল।

রাজনীতিও এই জনপদের মানুষদের নিয়ে নির্মম খেলা খেলে। নির্বাচনের আগে নানা মিথ্যা প্রতিশ্রুতি—তিস্তা সেচ প্রকল্প বাস্তবায়ন, পানি বণ্টন সমস্যা সমাধান ইত্যাদি শোনা যায়। কিন্তু ক্ষমতায় বসেই তারা ভুলে যায় সেই প্রতিশ্রুতি। ফলে দরিদ্র আরও দরিদ্র হয়, বিত্তবান আরও বিত্তশালী।

এভাবেই ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় ধ্বংসের পথে এগিয়ে চলছে এই অবহেলিত জনপদ। হে সভ্যরা, ভালো থেকো। সময়ের আবর্তে আমাদের ইতিহাস এবং অস্তিত্বকে একটু ঠাঁই দিও তোমাদের স্মৃতির কোনো এক কোণে।

 

---

লেখক পরিচিতি:

আশিকুর রহমান

শিক্ষার্থী, আল-ফিকহ্ অ্যান্ড লিগাল স্টাডিজ

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া

সহযোগী সদস্য, বাংলাদেশ তরুণ কলাম লেখক ফোরাম, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় শাখা

ইমেইল: mdasiqurrhmanasiq@gmail.com

 

---